Sunday 28 December 2014

ছয়টি তারে লুকিয়ে আছে Chhoyti tare lukiye aachhe

১.
সারাদিন ক্লাস,ল্যাব,টিউটোরিয়াল তারপর বিকেল বেলা গিটার শিখতে যাওয়া, ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া আর ফিরে এসে রাতে আবার গিটার নিয়ে বসা। এভাবেই গত ১ মাস ধরে ব্যাস্ত সময় কাটে ফাহমির। ইতিমধ্যেই মিসেস রহমান ভীষণ বিরক্ত হয়ে গেছেন সবসময় গিটার এর টুংটাং শুনতে শুনতে।
তিনি সারাদিন এই ভাবনাতেই থাকেন যে কি করে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন গিটার নিয়ে থাকতে পারে! মাঝে মাঝে অবশ্য এর জন্য কম বকা খেতে হয় না ফাহমিকে।
তবুও সে চালিয়ে যেতে থাকে টুংটাং শব্দ আর অপরিপক্ক হাতে কিছু গানের রিদম তুলার চেষ্টা। মিসেস রহমানের মত ফাহমির বন্ধুরাও কিছুটা বিরক্ত গিটারের যন্ত্রণায়। কারণ তখনও ফাহমি বেশি কিছু শিখে উঠেনি। এর একটা প্রধান কারণ হল গিটার শেখানোর শুরুতেই কাউকে রিদম শেখানো হয় না,প্রথমে গ্রামারটাই শেখানো হয়। এত মানুষের বিরক্তির মাঝেও একজন কখনই বিরক্ত হত না। সে হল ফাহমির অনন্যা। অনন্যা মেডিকেল এর ছাত্রী আর খুব ভালো নাচ ও পারে। গুণের দিক থেকেতো বটেই ধৈর্যের দিক থেকেও অনন্যা সত্যিই একজন অনন্যা, কেননা ফাহমির গিটার নিয়ে সকল ধরনের পাগলামি অনন্যা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে। কখনও একটুও বিরক্ত প্রকাশ করে না বরং ফাহমিকে উৎসাহ যোগায়। তাই ফাহমিও মনের আনন্দে গিটার এর নতুন যা কিছুই শিখে সেটা অনন্যাকে ফোন দিয়ে আগে শোনায়।
২.
তিন মাস এভাবেই পার হয়ে গেল। ফাহমি এখন খুব দক্ষ হয়ে উঠেছে গিটার বাজানোতে। এখন সে অনেক গানের রিদম তুলতে পারে অনেক ধরনের টিউন তুলতে পারে। কিন্তু আগের স্বভাবটা ঠিক রয়ে গেছে বরং বলা যায় আগের থেকে একটু বেড়েছে। এখন মাঝে মাঝে গান রেকর্ড করে সে অনন্যাকে দেয়। অনন্যাও মনের আনন্দে সেগুলো শুনতে থাকে,একবার দুবার নয় বারবার। মিসেস রহমানও এখন অনেক স্বস্তিতে আছেন,কারণ এখন তিনি শ্রুতিমধুর অনেক কিছু শুনতে পান। আর ফাহমির কাছে গিটারের ছয়টি তার যেন নিজের মনের সব দুঃখ,কষ্ট,সুখ,আনন্দ প্রকাশের একটা অন্যতম মাধ্যম। মন ভালো থাকলে তার গিটারে বাজত প্রিয় সব মেটাল গানের সলো আর মন যখন খারাপ থাকত তখন গিটারে বাজত সফট মন খারাপের কোন গানের সলো। সেই শুরু থেকে শুনতে শুনতে অনন্যার এমনই অবস্থা যে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে ফাহমিকে ফোন দিত আর যেকোনো একটা গান অথবা সলো শোনাতে বলত। আর যখন ফাহমি বাজাত তখন শুনেই অনন্যা বলে দিতে পারত আজ ফাহমির মন খারাপ নাকি ভালো। ফাহমি অনেকবার চেষ্টা করেছে এই মেয়েটাকে ধোঁকা দেওয়ার কিন্তু পারে নি। ফাহমি খেয়াল করে দেখে তার মা ও এই বেপারটা ধরতে পারে। তাই কৌতূহলবশত একদিন সে অনন্যাকে জিজ্ঞেস করে বসে তুমি কিভাবে বুঝ? অনন্যা মুচকি হেসে জবাব দেয় তুমি লুকাতে পার ঠিকই কিন্তু তোমার গিটার পারে না,তোমার গিটারটা সব বলে দেয় তোমার হয়ে। ফাহমি ভাবে সত্যি হয়ত তাই। সে নিজেও তো মাঝে মাঝে মনের অবস্থার বিপরীতে গিয়ে বাজাতে চেষ্টা করে কিন্তু গিটারটা সেটা কিছুতেই হতে দেয় না। সে ভাবে তার এই প্রিয় বন্ধুটির ছয়টি তারে অসীম ক্ষমতা। নিমেষেই খারাপ মন ভালো করে দিতে পারে আর যেকোনো পরিস্থিতিতে সঙ্গ দিতে পারে। পুরনো অভ্যাস মত ফাহমি গিটার নিয়ে তার মনের সমস্ত কথা বিরাট একটা ই-মেইল করে অনন্যাকে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন রাতেও সে গিটারটিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরে।
৩.
মিসেস রহমান নিত্যদিনের মত ঘর পরিস্কার করছেন। হটাৎ তিনি দেখতে পেলেন গিটারটি বিছানার উপর পরে আছে আর তাই বেশকিছু ধুলো জমেছে এর উপর। তাই তিনি সেটা পরিস্কার করার জন্য হাতে নিলেন। পরিস্কার করতে গিয়েই অসাবধানতাবশত গিটারের একটি তার ছিঁড়ে যায়। সাথে সাথে মিসেস রহমানের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠে। অদ্ভুত হলেও সত্যি সেদিন তার কুসংস্কারাছন্ন মনটা ঠিক বলেছিল। সেদিনের পর থেকে ফাহমি সেই রুমে আসেনি আর তার গিটারও বাজেনি। অনন্যা সহ রিকশা করে বাসায় আসার পথে তাদের এক্সিডেন্ট হয়। অনন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও ফাহমি পারেনি। সেদিন সব আত্মীয়স্বজন মিলেও মিসেস রহমানকে সান্ত্বনা দিতে পারেনি। তার ধারনা ছিল তিনি ই হয়ত গিটারের তারটি ছিঁড়ে তার ছেলের মৃত্যু ঘটিয়েছেন।
৪.
১০ দিন পর অনন্যা যখন হাসপাতাল থেকে রিলিস পেল তখনই সোজা ফাহমির বাসায় আসলো আর তার গিটারটি সাথে করে নিয়ে গেল। প্রথমে মিসেস রহমান দিতে রাজি হননি, কিন্তু অনন্যাকে দেওয়া ফাহমির সেই বিশাল ই-মেইল টি পড়ার পর দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। দেওয়ার সময় শুধু অনন্যাকে একটি কথা বললেন, গিটারটা যখন আবার কথা বলতে শিখবে তখন আমাকে এসে শুনিয়ে যেও। অনন্যা টলমল চোখে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল। বাসায় যাওয়ার আগে সে গিটারের ছেঁড়া তারটি ঠিক করে নিল,নতুন তার লাগিয়ে নয় পুরনোটাই টেনেটুনে ঠিক করে। জানালার পাশে বসে আছে অনন্যা,বাইরের আকাশ মেঘে ঢাকা। একটু পরেই মেঘ কেটে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে,পথঘাট ভিজে একাকার হয়ে যায়। অনন্যার মনে তখনও মেঘ জমে আছে,ফাহমির যাওয়ার পর একবারও তার দুচোখ ভেঙ্গে বৃষ্টি আসেনি। একহাতে গিটার আর অন্যহাতে ফাহমির সেই বিশাল ই-মেইল নিয়ে অনন্যা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একলা ভিজতে থাকা অপরাজিতা গাছটার দিকে। গাছটার মতই সেও আজ একা এবং অপরাজিতার নীল আর তার বেদনার নীল ও মিলেমিশে একাকার। পিছনে এফ.এম. এ গান বাজছে আর অনন্যার ঝাপসা চোখ চলে যাচ্ছে ই-মেইলের দিকে...

প্রিয় অনন্যা,

কথাগুলো তোমাকে ফোনে বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু এত রাতে তোমাকে আবার বিরক্ত করতে চাইনি। আমি জানি তুমি এখনই বলবে “শোনো আমি কখনও বিরক্ত হই না,বুঝছ?” তারপর আমার সবচেয়ে প্রিয় কথাটাই আমি আরেকবার বলবো “তোমার মত শান্ত মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনাই”। হাহাহাহা এবার নিশ্চয় একটু খেপেছ? যাই হোক, আসলে তোমার ফোন রাখার পর আমিও কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম, তোমার কথাগুলোই ঠিক। আমার গিটারটার ছয়টি তারে যেন ছয় রকমের অনুভূতি লুকানো আছে। প্রতিটি তার যেন জানে তাদেরকে ঠিক কখন বাজতে হবে

অউফফ অনেক গম্ভীর কথা বলে ফেললাম এর জন্য আবার আমাকে বকাবকি কর না। “হ্যাঁ তুমি শুধু এসব কথা বল, খালি ছেড়ে যাব হেন তেন :/ আমাকে আর পছন্দ না হলে বল...... ব্লা ব্লা ব্লা” :p । আরে আমি তো শুধু তোমাকে ধরতে বলেছি মানে মনে করতে বলেছি আর কাল্পনিক জিনিস কি কখনও সত্যি হয়? বাস্তবে তো আসলে এমন কিছুই হবে না। বাস্তবে তো আমরা পাস করে বের হব তারপর আমাদের বিয়ে হবে আর আমি তোমাকে বিয়ের পর সব শিখিয়ে দিব। আর তারপর আমরা দুজনে মিলে কথা বলাব গিটারকে দিয়ে। ও তোমাকে তো বলা হয়নি আমার অসম্ভব প্রিয় জেমস এর সেই গানটা “গিটার কাঁদতে জানে” আজকে তুলে ফেলেছি। এই ফাইলের সাথে এটাচ করে দিয়েছি,শুনে বলবে কেমন লেগেছে। আমি অবশ্য জানি তুমি ভালো ছাড়া অন্যকিছু বলবে না সে আমি যত জঘন্য গাই না কেন। হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তুমি এখন মনে মনে বলছ “তুমি মোটেও জঘন্য গাও না তুমি অনেক ভালো গাও” :p । জানো বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। তোমার জন্য কিছু লাইন লিখেছি,


 “তোর জন্য জমিয়ে রাখা  সকল পাতা,

ইচ্ছেমতন সুর দেওয়া মোর গানের খাতা।

তোর কাছেই গচ্ছিত থাক একটি আশা,

আমার এপিটাফে যেন থাকে লেখা,



তোকেই দিলাম,

সবুজ ঘাসের বর্ষার স্নান।

তোর জন্যই,

আমার এই একঘেয়েমি গান”।।



ভালো থেকো অনন্যা, অনেক অনেক ভালো থেকো। শুভ রাত্রি।

তোমার ফাহমি


অনন্যা উঠে দাঁড়াল এফ.এম. বন্ধ করে মোবাইল থেকে রেকর্ড করা গানটি চালিয়ে আবার গিটারটিকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসলো। সারা ঘরময় বেজে চলেছে, “ছয়টি তারে লুকিয়ে আছে ছয় রকমের কষ্ট আমার”। এবার বাঁধ মানল না। অনন্যার দুচোখ ভেঙ্গে নেমে এল অঝর বৃষ্টি।



“ছয়টি তারে লুকিয়ে আছে,ছয় রকমের কষ্ট আমার

ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের মত,নির্ঘুম রাত জেগে জেগে

গিটার কাঁদতে জানে,গিটার কাঁদতে জানে



অভিমানী একটি তারের নিজ চোখের মত

চিরদুখি একটি তারের বুকটা জমাট ক্ষত

ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের মত,নির্ঘুম রাত জেগে জেগে

গিটার কাঁদতে জানে,গিটার কাঁদতে জানে



একা নামের একটি তারের সুখের একটু পাশে

পরবাসী তারটি বরও বিষাদ ভালোবাসে

ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের মত,নির্ঘুম রাত জেগে জেগে

গিটার কাঁদতে জানে,গিটার কাঁদতে জানে”


                                                             লিখেছেন - সত্যজিৎ রায়