বড়মামার বাড়িতে যাওয়ার জন্যে আমি খুব
বায়না করতাম। শুধু আমি নই, আমার সব মাসতুতো ভাইবোনেরা তো বটেই, এমনকি আমাদের
বন্ধুরাও কেবল গল্প শুনেই বড়মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য তাদের মা বাবাদের জালিয়ে মারত।
কেউ কেউ আবার আফসোস করে বলত, ইস, আমারও যদি ওরকম একটা মামা থাকত।
আমাদের ছিল কিন্তু গেলেই যে বড়মামার সাথে
দেখা হবে এমন কোন গ্যারেন্টি ছিল না।
টানা এক সপ্তাহ থেকেও বড়মামার দেখা পাইনি,
এমনও হয়েছে। কখন যে কোথা থেকে ডাক আসে, কিছুই তো বলা যায় না। এত বড় একজন শিকারি।
বড় মামা যে খুব বড় মাপের শিকারি, তা তার
বাড়ি গেলেই মালুম হত। আগেকার দালান বাড়ি। বিশাল বিশাল ঘর। দেওয়ালের এখানে সেখানে
টাঙানো হরিনের শিং, আর সঙ্গে দুটো বন্ধুকও ছিল। বিছানায় চাদরের বদলে টান টান করে
পাতা থাকত বাঘের ছাল। ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া প্রশস্থ সিঁড়ি বেয়ে দোতুলা উঠতে উঠতে ডান
দিকে বাঁ দিকে পড়ত তির ধনুক, বর্শা, ঠিক মনে পড়ছে না ঢাল টাল দেখেছি কি না। সেই
মামা বাড়িতে থাকলে দুপুরে কিছুতেই ঘুমতুম না । পিঠ চুলকে চুলকে দিতে দিতে কিমবা
পাকা চুল তুলতে তুলতে তার শিকারের গল্প শুনতাম। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম, তাঁর চালতা
দিয়ে বাঘ শিকারের গল্প।
একবার তিনি গিয়েছিলেন এক মানুষখেকো বাঘ
শিকার করতে। পিকলা ফরেস্টের রেঞ্জার সাহেব অনুরোধ না করতে পারেন নি। সোজাসোজি চলে
গিয়েছিলেন ফরেস্টে। ভেবেছিলেন শিকারের খবরটা দিয়ে রেঞ্জার সাহেবকে চমকে দেবেন।আগেও
কতবার গিয়েছেন জঙ্গলে কিন্তু কিছুটা গিয়েই উনি পথ হারিয়ে ফেললেন এবং পথ খুজতে
খুজতে কিছুক্ষনের মধ্যে এমন অন্ধকার নেমে এল যে সেদিন গাছেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত
নিলেন মামা। উঠেও পড়লেন একটা গাছে। এবার একটু বিশ্রাম। হাত ঘড়ির রেডিয়ামে শুধু
বোঝা যাচ্ছিল রাত কটা বাজে। সারা দিনের ধকলে চোখদুটো বোধহয় একটু বুজে এসেছিল। তার
তখনই কী করে যেন কাঁধ থেকে খসে পড়ল বন্দুকটা, যা ছোটোখাটো শিকারিদেরও সচরাচর হয়
না। নীচে চোখ যেতেই বড়মামা স্থির। সকাল তখন হয় হয়। সেই অস্ফুট আলোয় মামা দেখলেন,
নীচে একটা বাঘ। বাঘ মানে চিতা বাঘ। যাকে বলে জাগুয়ার। হলুদের ওপর কালো ছোপ ছোপ।
গাছে চড়তে ওরা ওস্তাদ। তবু সে নীচ থেকেই মুখ উঁচু করে শুধু দেখতে লাগল বড়মামাকে।
মামাও তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই ভাবে কতক্ষন কেটে গেছে খেয়াল নেই। বাঘটাই চোখ
সরিয়ে গাছটাকে ঘিরে চলাফেরা করতে লাগল। দেখতে দেখতে আকাশটাও পরিস্কার হয়ে এল।
কিন্তু বাঘের নট নড়ন চড়ন। মাঝে মাঝেই সে প্রায় দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে দিচ্ছে গাছের
কান্ডে। নখ আঁচড়াচ্ছে । আর
বড় বড় হাঁ করে গজরাচ্ছে। এবার
উপায়? মামা পড়লেন মহা ফাঁপরে। হটাৎ দেখলেন ,
যে গাছে উনি উঠেছেন, সেটা একটা চালতা গাছ। গাছ ভর্তি চালতা । বাঘটা গজরাবার জন্য
হাঁ করতেই বড়মামা একটা চালতা এক হ্যাঁচকায় ছিঁড়ে টক্কুস করে ফেলে দিলেন সেই মুখে।
বাঘটা সেটা চিবোতে লাগল। এই ভাবে যতবারই হাঁ
করে বাঘটা , মামাও ততবার একটা করে চালতা ছিঁড়ে বাঘের মুখে ফেলতে লাগলেন। বাঘটাও
চিবোতে থাকে। কয়েকটা চালতা খাওয়ার পর বাঘটা গাছের গোড়ায় বসে পড়ল। মামা বহু শিকার
করেছেন জীবনে, বুঝতে পারলেন সব। খুব সাবধানে নেমে এলেন নীচে। বাঘটা তখন অন্যদিকে
মুখ করে জিভ দিয়ে গোফ-টোফ চাটছে। নীচে পড়ে যাওয়া কাঁধে তুলে নিয়ে একটুক্ষন বাঘটাকে
ভালো করে দেখলেন, তারপর বাঘটার লেজ ধরে টানতে টানতে
সোজা চললেন সেই রেঞ্জার সাহেবের বাংলোর দিকে আর বাঘটা চিৎকার শুরু করলো, যেন বলছে ‘আমায়
ছেড়ে দিন, আর কোন আপনার সামনে আসবো না’। সাত সকালে খুনে বাঘটাকে ওইভাবে কান ধরে
নিয়ে আসতে দেখে রেঞ্জার সাহেব মূর্ছা যান আর কী?
এরকম কান্ড কারখানাই বেশি ঘটেছে বড়মামার
জীবনে। মামার এসব গল্প শুনে সবারই সন্দেহ হওয়ার কথা, আমাদেরও হত। আমাদের চাহনি
দেখে বড় মামা হয়ত বুঝতে পারতেন। তাই আমাদের সন্দেহ দূর করার জন্য নানা রকমের
যুক্তি খাড়া করতেন। সেবার বলেছিলেন
দেখবি যারা কুকুর পোশে তাদের কখনও কোনও
কুকুর কামড়ায় না, ওরা ঠিক বুঝতে পারে, এ ডগ লাভার। গন্ধতেই ওরা চিনতে পারে ঠিক
তেমনি , যারা বড় বড় শিকারী তাদের গায়ের গন্ধেই জন্তু জানোয়ারেরা বুঝে যায়, এ আমার
যম আর তাতেই তারা অর্ধেক কাবু হয়ে যায়। কোন কিছু করতে পারে না, আর আমিতো টক চালতা
খাইয়ে ওই বাঘটার দাঁত এমন টকিয়ে দিয়েছিলাম যে কচি কচি হরিন ছানা তখন তার থাবার
কাছে এসে ঘুরলেও সে নির্ঘাত মুখ ফিরিয়ে নিত। এমন কত যুক্তি যে মামা তুলে ধরতেন তার
ইয়াত্তা নেই তবুও মামাকে সন্দেহ হত। মনে হত, মামার শিকার টিকার সব মিথ্যা, সবই
বানানো। কিন্তু এই সন্দেহ টুকুও একদিন কেটে গেল, মামি তো আর মা এর কাছে মিথ্যা
বলবেন না, সেই মামির কাছেই মা যখন একদিন জিজ্ঞেস করলেন মামার কথা, তখন কোনও ভনিতা
না করেই মামি বলে দিলেন, উনি শিকারে গেছেন। এই দেখে শুনে আমার আর সন্দেহ রইল না
মামার কীর্তির ওপর। মামাকে আমি মনে মনে তুলনা করতে লাগলাম অরণ্যদেব, রবিনহুডদের
সঙ্গে।
এরকমই একদিন মামির কাছে মামা শিকারে গেছেন
শুনে দেওয়ালের দিকে চোখ পড়তেই আমি অবাক। মামা শিকারে গেছেন, অথচ দু দুটো বন্দুকই
যে দেওয়ালে ঝোলানো । তবে কি মামা আর একটা বন্দুক কিনেছেন? পরে অনেক পরে জেনেছিলাম
মামি মিথ্যা বলতেন না। মামা সত্যি সত্যি শিকারে যেতেন। তবে বাঘ ভালুক হাতি সিংহ
নয়, মামা শিকার করতেন উইপোকা, ঘুনপোকা। আসলে বড় মামার পেস্ট কিলারের ব্যাবসা ছিল।
সেই সুবাদে দুর্গাপুর, কাল রানিগঞ্জ, পরশু কোচবিহার করতেন। মামি তাই ঠাট্টা করে
বলতেন উনি শিকারে গেছেন।
---সিদ্ধার্থ সিংহ