Tuesday 10 March 2015

মহাসংকটে পুরন্দর

পুরন্দরের আজ বড়ই দুর্দিন।
এমন ঘোর বিপদে সে বহুকাল পড়েনি। স্যান্যালবাবুদের ছোট ছেলে রাজুকে ভীমরুলের কামড় খাওয়াবার দোষটা পুরোপুরি তার ঘাড়ে বর্তেছে অথচ পুরন্দর ব্যপারটার মাথা মুন্ডু কিছুই জানত না। পরিকল্পনাটা পুরোটাই ধুরন্দরের।
হয়েছিল কি দ্বাদশবাড়ির জঙ্গলে কাঁচামিঠে আমের লোভে গিয়েছিলো দুভাইতে। ধুরন্ধরই লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই একটা গাছের মগডালে পুঁটুলিতে বাঁধা কিছু সোনার গহনা পেয়েছিল তারা। বাড়িতে এনে পুরন্দরের স্কুল ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছিল গহনাগুলো। বিকেলে অবশ্য দারোগা কাকু এসে নিয়ে গিয়েছিল পুঁটুলিটা। খবরটা বেশ চাউর হয়ে গিয়েছিল এলাকায়।
স্কুলের বন্ধু এবং শত্রুদেরও কানে গিয়েছিল কথাটা । সেই সুবাদে একদিন স্যান্যালবাবুদের ছোটছেলে রাজু একফাঁকে দেখা হতেই চোখ নাচিয়ে জানতে চেয়েছিল, ধুরন্ধররা সেদিন সবটাই গহনা দারোগার হাতে তলে দিয়েছিল, নাকি খানিকটা লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল?
রাজুটাকে কোনকালেই দুচোক্ষে দেখতে পারত না ধুরন্ধর। বড়লোকের আহ্লাদে ছেলে। দেমাকে যেন ফেটে পড়তে চায়। সারাক্ষন ওপরচালাকি করে। আর কারনে অকারনে খ্যা খ্যা করে হাসে। তার হাসবার কোনও সময় অসময় থাকেনা । সেই ছোটবেলা থেকে কথায় কথায় হেসে ওঠাটা তার একটা মারাত্মক রোগ। আর এমনিই সে হাঁসি, একবার শুরু করলে আর থামতেই চায় না। ওই বেয়াড়া হাসির জন্য কতবার মার খেয়েছে ইস্কুলে তার ইয়াত্তা নেই। এমনও হয়েছে যে, মাস্টার মশাইয়ের প্রশ্নের ভুল জবাব দেওয়াড় সুবাদে মার খাওয়ার কথা ছিল নরেনের, কিন্তু ভুল জবাব শোনা মাত্র আচমকা এমনি হাঁসতে শুরু করলো রাজু , খেপে গিয়ে মাস্টারমশাই, রাজুকেই পেটাতে লাগলেন এবং নরেনকে পেটাবার কথা ভুলেই গেলেন।
এইসব সাত সতের কারনে রাজুটা চিরকালই ধুরন্দরের দুচোখের বিষ। আর ছোটভাই দেখতে পারেনা সেই কারনে সে পুরন্দরেরও দুচোখের বিষ।
গহনার পুটলির ব্যাপারে রাজুর এমন সন্দেহর চোখে দেখে এবং সন্দেহটা প্রকাশ করার ধরন দেখে হাড় অবধি জ্বলে গিয়েছিল ধুরন্ধরের, কাজেই পাল্টা চাল মেরেছিল সেও। বলেছিল, সত্যিই খানিকটা গহনা লুকিয়ে রাখতে পেরেছে ওরা । দিঘির পাড়ে পুরোনো কুচলা গাছের কোটরের মধ্যেই রয়েছে ওগুলো। না নিজের মুখে কথাগুলো বলেনি ধুরন্ধর। দাদা পুরন্দরকে দিয়েই বলিয়ে ছিল। সেটাই ধুরন্দরের চিরকালের অভ্যাস। কাউকে কোন গোপন কথা জানাতে চাইলে সে পুরন্দরকে দিয়েই বলায়। বলে, দাদা তুই বড় তুই বল।
দাদার প্রতি ধুরন্দরের এমন লক্ষনের মত ভক্তি দেখে পলকের মধ্যে গলে আলুসেদ্ধ হয়ে যায় পুরন্দর। ধুরন্ধর যা বলতে বা করতে বলে, তৎক্ষনাৎ তা করে দেয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ধুরন্দরের নির্দেশে পুরন্দরই কথাগুলো বলেছিল।
এমন কি রাজুকে সেই নিয়ে গিয়েছিল কোটরের কাছে । পুরন্দরের উস্কানিতেই রাজু হাত ঢুকিয়ে ছিলো কোটরের মধ্যে। সেতো জানতই না সোনার গহনা নয় বিশাল এক ভীমরুলের চাক রয়েছে কোটরটার মধ্যে, এমনকি পুরন্দরও জানত না তা। ধুরন্ধর সারাক্ষন নিরাপদ দূরত্বে ছিল। শেষ মুহুর্তে পুরন্দরকে ডেকে নিয়েছিল কাছটিতে কাজেই ভীমরুলরা ওদের নাগাল পায়নি, কিন্তু রাজুর অবস্থা করুন করে ছেড়েছিল প্রায় মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছিল বেচারা কিন্তু রাজুর যাবতিয় দুর্গতির দায় বর্তেছিল কেবল পুরন্দরের ওপর । কারন রাজুর সাক্ষ্য অনুসারে পুরন্দরই দিয়েছিল গহনার খোজ। সে-ই রাজুকে নিয়ে গিয়েছিল কোটরের কাছে বারংবার প্ররোচিত করছিল কোটরের মধ্যে হাত ঢোকাবার জন্য ততক্ষনে পুরন্দর বুঝে ফেলেছে ছোট ভাইয়ের খোসামোদি কথায় মজে গিয়ে দাদাগিরি ফলাতে গিয়ে মহাসংকটে পড়ে গিয়েছে সে। এর আগেও ধুরন্ধরের কুকর্মের দায় নীজের ঘাড়ে এসে পড়ায় ঢের মাসুল গুনতে হয়েছে পুরন্দরকে। কিন্তু এই সংকটের সাথে ওগুলোর তুলনা চলে না, এবারের বিপদটার ধরনই আলাদা মুলত তিনটি কারনে, এক ভীমরুলের কামড় খেয়ে মরতে বসেছিল একটি ছেলে, দুই সেই ছেলেটি আর কেউ নয় গোটা এলাকার সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশীল সান্যাল পরিবারের ছোট ছেলে, তিন সারা ইস্কুলের তাবৎ ছাত্রের চিরকালের যম , অঙ্কের মাস্টার মুকুন্দ সার থাকেন সান্যাল পরিবারেই। রাজুকে দুবেলা পড়ানোর বিনিময়ে সান্যালবাড়িতে তার থাকা খাওয়া ফ্রী। পুরো মাইনেটাই পাঠাতে পারেন বাড়িতে। সান্যাল পরিবারের প্রতি সেই কারনেই কিছু বাড়তি কৃতজ্ঞতা রয়েছে মুকুন্দস্যারের মনে। অঙ্কের মাস্টার মুকুন্দবাবুকে দেখলে উঁচু ক্লাসের ছেলেদেরও বুক ধুকপুক করে। কোথায় লুকোবে খুঁজে পায় না। অঙ্কের ক্লাসে তার চোখ দুটো  যখন বাঘের মত জ্বলতে থাকে, লিকলিকে বেতগাছা যখন শূন্যে মুহুর্মুহু গর্জন তুলতে থাকে, তখন সারা স্কুলে খুব কম ছাত্রই আছে যারা নিজেকে সামলে রাখতে পারে। মুকুন্দবাবুর আরও একটা বিখ্যাত জিনিস হল গাঁট্টা। তাঁর হাতের গাঁট্টা একটিবার যে খেয়েছে সারা জীবনেও ভুলতে পারবে না তা।
ছাত্ররা আড়ালে-আবডালে ওই নিয়ে ছড়া কেটেছে -
মুকুন্দস্যারের গাঁট্টা
পয়সার আটটা।
সান্যাল পরিবারে বারোমাস তিরিশ দিন থাকবার সুবাদে রাজুর প্রতি বেশ দুর্বলতা তো রয়েছেই মুকুন্দবাবুর তার ওপর ভীমরুলের কামড় খেয়ে আধমরা অবস্থায় ঘরে ফিরলে পর ওর অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি। তখন থেকেই মুকুন্দবাবু অপরাধীকে সাজা দেবার ব্যাপারে মনস্থির করেই ক্ষ্যান্ত থাকেননি তিনি, রাজুর শোকসন্তপ্ত বাবস মার সামনে সদম্ভে ঘোষনাও করে দিয়েছেন যে সোমবার স্কুল খুললে অঙ্কের ক্লাসে অপ্রাধীর বিচার হবে।
ভাবতে গিয়েই মাথাটা কেমন বারবার ঘুরে যায় পুরন্দরের। রাজুর বাড়িতে বারোমাস থাকা খাওয়ার সুবাদে বিচারটা বেশ ভালো করেই করবেন মুকুন্দবাবু। সাজাটা বেশ দরাজ হাতেই দেবেন নির্ঘাত। সাজার বহরটা আন্দাজ করতে গিয়ে বারবার পুরন্দরের পাটালি রঙের চোখের কোনা বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে অজান্তে।
।।২।।
আজকেই সেই সোমবার । দিন চারেকের ছুটির পর আজকেই স্কুল খুলেছে। অঙ্কের ক্লাস ফোর্থ পিরিয়ডে । ওই ক্লাসেই বিচার হবে পুরন্দরের । এখন সেকেন্ড পিরিয়ড । বাংলা ক্লাস। ক্লাসের সবাই ফরমাইশ গল্প লিখছে একমনে । বিষয় দুঃসময়ের বন্ধু। সবাই লিখছে , কেবল পুরন্দরের ভেতর থেকে চাপা কান্না উত্থলে, উপচে পড়তে চাইছে ঝলকে ঝলকে। কলমের ডোগা দিয়ে কাগজের বুকে অকারনে আঁকিবুকি কাটছে সে। একটি শব্দও তার মাথায় আসছে না । অথচ গল্পটা পুরন্দরের ও জানা ।
ওই যে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে দুই বন্ধু ভালুকের পাল্লায় পড়ল- একজন গাছের মগডালে চড়ে লুকিয়ে পড়ল অন্য জন গাছে উঠতে না পেরে মাটিতে শুয়ে পড়ল মড়ার মত, যাতে করে মরা মানুষ ভেবে ভালুক ওকে না খায় । ওই যে , ভালুকটা মাটিতে শুয়ে থাকা লোকটাকে বলল বিপদে যে পাশে দাঁড়ায় না তাকে কখনও বিশ্বাস করো না ।
গল্পটা বলতে গেলে পুরন্দরের মুখস্থ । ইচ্ছে করলে অন্যদের মত সেও খসখসিয়ে লিখে ফেলতে পারে একটানে । কিন্তু লিখতে গেলেই চোখের সামনে খাতার পাতায় অন্ধকার দেখছে সে।তার বদলে চোখ মুদলেই মুকুন্দসারের বাঘের মতো একজোড়া জ্বলন্ত চোখ একগাছা লিকলিকে বেতের অবিরাম গর্জন_ _ _। তবলায় হাঁতুড়ি  ঠোকার ভঙ্গিতে মাথায় ও পর আছড়ে পড়ছে ডজন ডজনে গাঁট্টা_ _ _।
এমন ঘোর বিপদের মুহূর্তে মানুষ সঙ্গী খোঁজ চারপাশে। তার থেকে আশ্রয়, প্রশ্রয়, বল ভরসা পেতে চায়। পুরন্দর আড়চোখে তাকাল ছোটভাই ধুরন্দরের দিকে । কিন্তু না ধুরন্দরের তখন দাদার দিকে তাকাবার তিলমাত্র ফুরসত নেই। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে তখন চোখমুখ কুঁচকে , ভ্রু জোড়ায় অজস্র ভাঁজ তুলে, একমনে খসখসিয়ে খাতায় লিখে চলেছে খাতার পাতায়। পুরন্দরের বারংবার ডাকাডাকিতে তার কলমের গতি তিলমাত্র কমে না।
প্রচন্ড দুঃখে আর অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় পুরন্দর। এই দুনিয়েটাই সার্থপর। সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, দুঃসময়ে হায় হায় কেউ নয়। এ দুনিয়ায় সবাই সুখের দিনের পায়রা।
বিপদের দিনে পাশে কেউ না থাকলে  ভয়টা আরও বেড়ে যায়। পুরন্দর ভয়ের চোটে মনে মনে চারপাশের সব ঠাকুর – দ্যাবতাকে ডাকতে লাগল আকুল গলায়। হে মা কালী , শেতলা , চন্ডী - - হে মা বিশ্বকর্মা , গ্রহবর্মা-- , এই গেরো থেকে তোমাদের অধম সন্তান কে বাঁচাও মা। তোমরা তো সবই জানো মা, আমার কোন দোষ ছিল না সেদিন। আমাকে আমার ছোট ভাই ধুরন্ধরই বলেছিল। ক্ষীরকুল গাছের কোটরে নাকি সোনার গহনা লুকানো আছে। আগের দিনই কথাটা শুনিয়ে রেখছিল আমায়। পরের দিন ওর কথা মতোই আমি জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছিলাম রাজুকে। আমি কি করেই বা জানব মা, কোটরের মধ্যে গহনার বদলে ভীমরুলের বাসা। মা, মাগো, তোমাদের রাজত্বে কি বিচার নেই মা? দোষ করল ধুরন্ধর, আর মার খাব কিনা তোমাদের এই অবোধ সন্তান? ব্যাপারটা তোমরা মুকুন্দ স্যারের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে দিয়ো মা। কিম্‌বা আকাশ থেকে দৈববানী করো। এরকম তো তোমরা যুগে যুগেই অনেকই করেছ মা। আর একটি বার না হয়----।
কিন্তু কোনও দেবতাই সাড়া দেন না পুরন্দরের আকুল প্রার্থনায়। পুরন্দরকে কোনরুপ আশ্বাসই দেন না তাঁরা। এযুগের ঠাকুর দেবতাদের উপর ঠিক ভরসাও রাখা যায় না। অতীতে বহুবার গাড্ডায় পড়ে ঠাকুর দেবতাদের ডেকে কোন ফল হয়নি পুরন্দরের। কাজেই,সময় যতই বয়ে যেতে থাকে, ততই গায়ের কাপুনি বেড়ে যেতে থাকেপুরন্দরের।
রাজুর মুখের দিকেও একঝলক তাকাল পুরন্দর। সারাক্ষন খুব দেমাকি মুখ করে রয়েছে সে। আজ যে পুরন্দরের কী ভয়ানক বিচার হবে অঙ্কের ক্লাসে। সেটা বোধ করি ভালো মতোই জানে। সেটা ভেবেই ফুর্তিটা বুঝি বা বেড়ে যাচ্ছে তার মনে। পুরন্দরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রাজুর ঠোঁটের ফাঁকে এক ধরনের নিষ্ঠুর হাসি উঁকি মেরে মিলিয়ে গেল। তাই দেখে সারা শরীর কেপে কেপে উঠছে এক অজানা আতঙ্কে।
।।৩।।
  সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হতেই সবাই বেরিয়ে এল ক্লাসের বাইরে। থার্ড পিরিয়ডে পন্ডিতমশায়ের সংস্কৃতের ক্লাস। অন্তত পনের মিনিটের আগে ক্লাসে আসেন না পন্ডিতমশাই। এতক্ষনে হয়তো কমন রুমের এককোনে বসে টেবিলের ওপর দু ঠ্যাং তুলে দিয়ে নাকের পাটায় গর্জন তুলেছেন। এ সময়টায় ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করে সবাই। রোজ পুরন্দরও ওই গল্পগুজবে সামিল হয়।
  কিন্তু আজ আর গুলতানি মারার মতো মনের অবস্থা নেই তার। তার বুকে কে যেন দুরমুশ পেটাচ্ছে অবিরাম। চোখের কোল ভিজে আসতে চাইছে বারবার। অসহায় চোখে এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে সে। এমন ভয়ানক মুহূর্তে একচিলতে সহানুভুতি খুঁজছে সহপাঠিদের মুখে। এসময়টা ধুরন্ধরটা পাশে থাকলে একটুখানি ভরসা পাওয়া যেতো। কিন্তু সে আজ সকাল থেকেই দাদার পাশাপাশি ভিড়ছে না। পাছে দাদার কাছাকাছি থাকলে আজকের ঝড় ঝাপটার ছিটেফোঁটা ওর ওপরেও এসে পড়ে, সেই কারনেই ওকে এড়িয়ে চলতে চাইছে সে। পুরন্দর দেখল লম্বা বারান্দায় একপ্রান্তে একলাটি দাঁড়িয়ে আছে ধুরন্ধর। অকুল পাথারে হাবুডুবু খেতে থাকা মানুষ যে মিন করে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, পরন্দরও তেমনি করে আঁকড়ে ধরতে চাইল ছোট ভাইকে। পায়ে পায়ে গিয়ে দাড়ালো তার পাশটিতে ধুরন্দরের চোখে মুখে দুর্ভাবনার লেশমাত্র নেই। বেশ হালকা, ফুরফুরে নির্বিকার মুখ তার। দাদার দিকে একঝলক তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল উল্টোদিকে।
আজ আমার বিচার হবে, জানিশ তো? ধরাধরা গলায় বলল পুরন্দর।
খুব সহজ ভাবেই মাথা নাড়লো ধুরন্ধর।
কে বিচার করবে জানিস তো? পুরন্দর কাঁদো কাঁদো গলায় আবার বলল।
আবার মাথা নাড়লো ধুরন্ধর।
ছোটভাইয়ের এরকম নিরাসক্ত ভাব দেখে দুঃখে, অভিমানে, বুকটা ফুলে ফুলে উঠল পুরন্দরের। বলল আমার এই ঘোর বিপদ তুই আমার পাশে দাঁড়াবি না? পুরন্দরের কথাগুলো কান্নার মতো শোনাচ্ছিল। তাই দেখে একচিলতে হাঁসি খেলে গেল ধুরন্ধরের ঠোঁটে। বলল এইতো দাঁড়িয়ে আছি তোর পাশটিতে।  ছোটভাইয়ের এমন ঠাট্টা মেশানো কথায় চোখে জল চলে এল পুরন্দরের। তাই দেখে ধুরন্ধর বেশ ভারিক্কি চালে বলল জানিস তো, নিয়তি কেন বাধ্যতে অর্থাৎ নিয়তি কারো বাধ্য নয়।
পায়ে পায়ে ক্লাসের দিকে যেতে যেতে ধুরন্ধর বলল এটা সংস্কৃত ক্লাস তো তাই সংস্কৃতে উপদেশ দিলাম তোকে।
।।৪।।
বামহাতে বিশাল বেতগাছা এবং মাথায় লম্বা টিকি দোলাতে দোলাতে ক্লাসে ঢুকলেন পন্ডিতমশাই। উদোম গা, খালি পা, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি । বেতগাছা সাপটে টেবিলের ওপর আছড়ে মারলেন বার দুই অর্থাৎ আমাদের বসতে বললেন পন্ডিতমশাই। তারপর মুনি শব্দের রূপ লেখ বলেই টেবিলের উপর ময়লা পা দুটো তুলে দিলেন। ওটা বহুবার লিখতে হয়েছে ক্লাসে কিন্তু কোনদিন খাতা দেখার ফুরসোত হয়নি তাঁর, তার আগের ঘন্টা বেজে যায় প্রতিবার। কাজেই প্রাই সকলের খাতাতে মুনি শব্দের রুপ লেখা রয়েছে, পন্ডিতমশায় চোখ মুজতেই সকলেই পুরানো লেখাটা খুলে বসল। তারপরে একটু সময় খম মেরে বসে থাকলো, কেনকি অত জলদি খাতা জমা দিলে সন্দেহ হতে পারে। তখন ঘুমটা সবে ধরেছে, আকস্মাৎ দুমদাম শব্দে খাতা জমা দিতে লাগলো টেবিলে। পন্ডিতমশাইয়ের কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। টেবিলের উপর নানা সাইজের খাতা দেখে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল তার। এই এতো খাতা তাকে দেখতে হবে বসে বসে? ঘন্টা বাজেনা কেন?
একটা খাতায় অলস হাতটা বাড়িয়েছেন সবে, তার আগেই আচমকা উঠে দাড়ালো ধুরন্ধর। খুব মিহি গলায় বলল, স্যার। সারা মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধুরন্ধরের দিকে তাকালেন তিনি। ততধিক মিহিসুরে ধুরন্ধর বলল, ‘হাহা’ শব্দের রূপটা কেমন হবে স্যার?
  পন্ডিতমশাই ভীষন চমকে উঠে দ্বিতীয়বার তাকালেন ধুরন্ধরের দিকে। তার সীমাহিন বিস্ময়ের কারন আছে। তার ক্লাসে কেউ কোনদিন আগ বাড়িয়ে কিছু শুধায় নি আজ বিশ বছর। ছাত্রদের এই অনীহাটা তাঁকে তিলতিল গ্রাস করেছে অজান্তে। সেই কারনেই আজকাল যখন তখন যেখানে সেখানে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
বিশ বছর বাদে হটাৎ তার ক্লাসে কিছু জানতে চেইছে ছাত্র! আজব ব্যপার! আরও অবাক কান্ড হল, সেই ছাত্র ধুরন্ধর নন্দী, যাকে কোনওদিন অনুস্বর বিসর্গ চেনানো যায় নি সঠিকভাবে।
পন্ডিতমশায়ের সারা মুখে গাঢ় সন্দেহে ভরে গেল। ধুরন্ধরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে শুধালেন, - হাহা শব্দের রুপ তুই পড়েছিস?
পড়েছি স্যার।
পন্ডিতমশায়ের সন্দেহ তবু যায় না। ধুরন্ধরের চোখেচোখ রেখে শুধোন – হাহা শব্দের মানে তুই যানিস।
জানি স্যার। হাহা হল একজন গন্ধর্বের নাম।
বাহ্‌। বহুদিন বাদে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পন্ডিত মশায়ের। ধুরন্ধরের দিকে গদগদ মুখে তাকালেন তিনি। তার এতোটা খুশির আরেকটা কারনও ছিল। ধুরন্ধরের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ওই পাহাড়প্রমান খাতা আর দেখতে হবে না তাঁকে। তার আগেই ঘন্টা বেজে যাবে। পন্ডিতমশায়ের চোখেমুখে খুশি দেখে উৎসাহ পেল ধুরন্ধর। বলল শব্দরূপটা আমি পড়েছি স্যার, কিন্তু উশ্চারনটা রপ্ত করা ভারী কঠিন। উচ্চারনকে উশ্চারন বলবার পরেরও মাফ পেয়ে গেল। অন্যদিন হলে গর্দভ, মর্কট, অকালকুষ্মান্ডু ইত্যাদি বিষেশনে ভূষিত করে ওকে কান ধরে বেঞ্চির উপরে দাঁড়করিয়ে দিতে নির্ঘাত। কিন্তু পন্ডিতমশাই সেই পথে হাঁটলেন না। তার বদলে খুব স্নেহভরে বললেন – কঠিন তো হবেই বাপ। এ হল দেবভাষা। দেবেনো ভাষিত্‌ম। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন পন্ডিতমশাই। সামনের দিকে তর্জনি তাক করে অর্কেস্ট্রার মিউজিক ডিরেকটরের ভঙ্গিতে তালে তালে দোলাতে লাগলেন হাত। সেই সঙ্গে জলগ গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন, হাহা শব্দের রুপ – হাহাঃ – হাহৌ হাহাঃ/ হাহাঃ – হাহৌ হাহাঃ/ হাহান – হাহৌ – হাহান – হাহা – হাহৌ – হাহান – হাহা/ ...... সারা ক্লাসঘর কাঁপিয়ে হাহাকার করে চলেছেন পন্ডিতমশাই। চোখেমুখে, কপালের বলিরেখায় অসংখ্য ভাঙচুর করে, ঘনঘন মাথাসহ টিকিখানি প্রবল বেগে দোলাতে দোলাতে চিৎকার করে চলেছেন তিনি। ক্লাসশুদ্ধ সবাই হাইবেঞ্চির আড়ালে মুখ লুকিয়ে প্রানপনে হাঁসি সামলাচ্ছে। একমাত্র ধুরন্ধর সুবোধ বালকের মতো অখন্ড মনোযোগ সহকারে শুনছে পন্ডিতমশায়ের ঘরকাঁপানো চিৎকার।
হাহাঃ – হাহাভ্যাম –হাহাভ্য/ হাহাঃ – হাহভ্যাম – হাহাভ্য / হাহাঃ – হাহৌ – হাহাম ......। দুচোখ মুদে হাহা শব্দে চেড়িয়ে চলেছেন। ততক্ষনে ঠিক সামনের বেঞ্চিতে বসে রাজুর চোখমুখ আপেলের মতো লালা হয়ে উঠেছে। এর চেয়ে অনেক সামান্য কারনে প্রবল হাঁসি শুরু হয়ে যায় তার। কিছুতেই সামলাতে পারেনা। এতোক্ষন কেবল পন্ডিতমশায়ের ভয়ে প্রানপনে চেপে রেখেছিল হাঁসি। কিন্তু পন্ডিতমশায়ের অমন অঙ্গভপঙ্গি সহকারে বাঁজখাই গলায় মিহুর্মুহু হাহা-কার শুনতে শুনতে সে আর কিছুতেই সামলে রাখতে পারল না নিজেকে। আচমকা পন্ডিতমশায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আরেকটা হা-হা ধ্বনি ভেসে এলো সামনের সারি থেকে। রাজু হাঁসছে। হা-হা, হো হো, হি-হি, খিক্‌খিক, খ্যাকখ্যাক হরেক আওয়াজ তুলে হাসতে হাসতে একসময় প্রবল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। প্রচন্ড চমক খেয়ে পন্ডিতমশায়ের গলা থেমে গেছে ততক্ষনে। মুদে থাকা চোখদুটি পূর্ন প্রস্ফুটিত হয়েছে। রাজুকে বারংবার দেখেও যেন নিজের কানকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁর ক্লাসে কেউ যে অমন গলা ফাটিয়ে হাসতে পারে, এ যেন তাঁর কল্পনারও অতীত। দুপাশের ছেলেরা রাজুকে চেপে ধরে থামাবার চেষ্টা করছে প্রানপনে। তাতে রাজুর হাসি আরোও বেড়ে যাচ্ছে। হা-হা-আ, হো-হো-ও-ও, হি-হি-ই-ই-ই, লম্বা সুরে তান ধরেছে সে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছে পাশের ছেলেদের গায়ে। পন্ডিতমশায়ের কপালের শিরাগুলো ততক্ষনে চিতি সাপের মতো ফুলে উঠেছে। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁটজোড়া কাপতে শুরু করেছে। একসময় টেবিল থেকে বেতগাছা তুলে নিলেন তিনি। পাক্কা পনেরো মিনিট পন্ডিতমশায়ের হাতের বেত থামল না এবং রাজুর সারা শরীর ফুলে ফুলে উঠল প্যাকাল মাছের মত।
।।৫।।
ফোর্থ পিরিওডে মুকুন্দবাবু ক্লাসে ঢুকেই জ্বলন্ত আগুনের ভাঁটার মত চোখদুটোকে বনবন করে ঘরময় ছোটাতে লাগলেন। হাতের বেতগাছা বারকতক আছড়ে হাঁক পাড়লেন তিনি পুরন্দর নন্দী। এদিকে আয়।
 পুরন্দরের হাঁটুতে হাঁটুতে প্রবল ঠোকাঠুকি চলেছে তখন। বুকের ধুকপুকানিটা কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারছে না। তেত্রিশকোটি দেবতাকে আকুল গলায় ডাকতে ডাকতে মুকুন্দস্যারের সামনে গিয়ে দাড়ালো সে। বলির পাঠার মতো কাপতে থাকলো ঠকঠকিয়ে।
রাজকুমারকে ভীমরুলের কামড় খায়িয়েছিস কেন? –ততক্ষনে হাতে তুলে নিয়েছেন হাতের বেতগাছা।
না স্যার, মিছে কথা স্যার। প্রানপনে চোখবন্ধ করে কোন গতিকে কথাগুলো উচ্চারন করল পুরন্দর।
মিছে কথা? মেঘেরমত গম্ভীর গলায় হাঁক পাড়লেন মুকুন্দস্যার, রাজকুমার সেদিন কি হয়েছিল, বল।
পুরন্দরের চোখদুটো বোজা ছিল। কানদুটো ভোঁ ভোঁ করছিল। তার মধ্যেও শুনতে পেল রাজুর গলা। পুরন্দরের কোন দোষ নেই স্যার। আমিই কৌতুহল বশে কোটরে হাত ঢুকিয়ে-।
নিজের কানকেও বুঝি বিশ্বাস করতে পারছিল না পুরন্দর। সে স্বপ্ন দেখিছে নাতো। নিদারুন ভয়ে, উৎকন্ঠায় তার সব বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পেলো নাতো।
খানিক্ষন ক্লাসে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সাহসে ভর করে ধীরে ধীরে চোখ খোলে পুরন্দর। মুকুন্দস্যার তখন অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে রাজুর দিকে। অল্পক্ষন বাদে বেতের গোছাটা ফেলে দিয়ে তাকালেন পুরন্দরের দিকে। তার সারা মুখে ফুটে উঠল শিকার ফসকে যাবার আক্ষেপ। বললেন- যা বেঁচে গেলি আজকের মতো। নিজের সিটে গিয়ে বোসগে যা।
বুকের ভিতরে ভয় আর ধুকপুকানিটা পুরাপুরি তখনো কাটেনি। তারই মধ্যে অপার বিস্ময়ে তাকালো রাজুর দিকে। ওর সাথে চোখাচুখি হওয়া মাত্র রাজু চোখ ফিরিয়ে নিল রাজু।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল দুইভাই। পথে আচমকা রাজুর সাথে দেখা।
রাজুর দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল ধুরন্ধর। বলল- আজকের ব্যপারটাতে আমি অবশ্যই খুশি হয়েছি। কিন্তু মনে রাখিস, আমার এই অস্ত্রটা একদিনের নয়। আমাদের মধ্যে কোন মতান্তর বা ঝগড়া হলে আমরা তো আলাপ আলোচনার মধ্যে মিটিয়ে নেব। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে যদি কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি করিস, অর্থাৎ ব্যপারটার মধ্যে যদি মাস্টারদের টেনে আনিস, তাহলে কিন্তু আমি আবার ওই অস্ত্রটি প্রয়োগ করবো। অর্থাৎ --। বলতে বলতে ধুরন্ধরের ঠোঁটের কোনায় একচিলতে অর্থবোধক হাসি খেলে যায়, - অর্থাৎ আমি আবার পন্ডিতমশায়ের ক্লাসে হাহা শব্দের রূপ জানতে চাইব।
লেখক- ভগীরথ মিশ্র
আনুলিখন- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী