আমি
সম্পাদক সাহেবের সামনে বসে আছি। আমাদের অফিসের তিন তলায়। জরুরি মিটিং হচ্ছে। এর
মধ্যে এই এসএমএস। আমি মোবাইল ফোনটা টেবিলের নিচে নামিয়ে সবার অগোচরে এসএমএস করি :
১০টা মিনিট বসো। আসতেছি। তারপর বেমালুম ভুলে যাই হিমেলের কথা। মিটিং থেকে বেরোই দেড়
ঘণ্টা পরে। রুমে এসে দেখি, হিমেল আশরাফ একটা চিরকুট রেখে গেছে আমার কম্পিউটারের কি-বোর্ডের
ওপরে। স্যার, আমি
আপনাদের ক্যান্টিনে।আমি ক্যান্টিনে যাই। বলি, একদম ভুলে গেছি হিমেল। স্যরি। আসো, চা খাই।স্যার, চা তো স্যার তিন কাপ খেয়ে
ফেললাম।ও। তাইলে আমি খাই। শোনো, কী বলবা বলো।স্যার, একটা গল্প পাইছি স্যার। আপনি লিখলে নাটক করতে পারি। আমি তো মিয়া নাটক লেখা ছেড়ে
দিছি। কী গল্প?
বলব?
এইটা
স্যার একটা প্রেমের গল্প।
প্রেমের
গল্পই তো হবে। নাটক বানাবা, আর প্রেম থাকবে না?
তবে
স্যার অন্যরকম প্রেমের গল্প। ঠিক আজকালকার প্রেমের গল্প না।
আজকালকার
প্রেমের গল্প কী রকম? আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলি।
হিমেল
আশরাফের বয়স ২৪-২৫ হবে, মাঝারি উচ্চতা। গালে দুদিনের দাড়ি, এইটা বড়ও হয় না, ছোটও হয় না। সে টেলিভিশনের
জন্য নাটক বানায়। পরিচালনা করে। ভালো বানায়। চোখ দুটো উজ্জ্বল। একটু বেদনাময়।
টি-শার্টের ওপরে একটা কালো জ্যাকেট পরে আছে। সাংঘাতিক বিনয়ী। কিন্তু পরিচালকেরা
যখন নিজের বনে যায়, তখন বাঘ হয়ে যায়। তার ইউনিটের লোকজনেরা এই নরম-সরম বিনয়ী
তরুণটিকেও বাঘের মতোই ভয় পাবে।
হিমেল
লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। বোঝেন না স্যার। আজকালকার পোলাপান তো, একসঙ্গে চার-পাঁচটা প্রেম
করে। একটা ছোটে। তিনটা জোটে। কিছুই যায় আসে না।
তাই
নাকি?
হ্যাঁ।
আপনি জানেন। আপনি আমারে বাজাইতেছেন।
না
না। জানি না। আজকালকার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেশার সুযোগ তো হয় না।
আরে
আপনি ফেসবুকে আছেন না। বাদ দেন স্যার। এইটা আপনাদের আমলের প্রেমের গল্প।
কী
রকম।
স্যার, যশোরে গেছেন আপনি কখনো?
গেছি।
রেলস্টেশনটা
দেখছেন?
না।
দেখি নাই।
ওইখানে
স্যার স্টেশনটা থেকে বাইর হইলেন দেখবেন, একটা কড়ই গাছ। ওই গাছটার নিচে ফুটপাতে, একপাশে রেলের পাত দেওয়া রেলিং, ওইখানে একটা লোক দেখবেন স্যার, কোট পরা, বিড়বিড় করে। গানটান গায়।
ভদ্রসদ্রই দেখতে। কিন্তু স্যার তার পায়ে কোনো জুতা-স্যান্ডেল নাই।
আচ্ছা।
লোকটা
স্যার ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। তাকে লোকে ডাকত ডাক্তার আবুল বাশার বিএসসি।
বিএসসি পাস করেছিল, স্যার।
তাই
নাকি। তো সেই লোক এখন রেলস্টেশনে আশ্রয় নিল কেন?
দিনের
বেলা রেলস্টেশনে থাকে। রাতের বেলা বাড়ি ফিরে যায়। পরনে কোট। একটা প্যান্ট। শাদা
শার্ট। মাঝেমধ্যে টাইও থাকে। শুধু পায়ে কোনো জুতা নাই।
কী
বলো? কেন?
লোকটা
কিন্তু আগাগোড়াই সৌখিন ছিল। এই রকম সাহেব হয়েই চলাফেরা করত।
তো
তার কী হলো? তিনি
জুতা পরা ছেড়ে দিলেন কেন।
ত্রিশটা
বছর তিনি জুতা-স্যান্ডেল পরেন না।
কেন?
সেইটাই
তো গল্প স্যার।
তিনি
একজনকে ভালোবাসতেন। যশোরের এক চৌধুরী পরিবারের এক মেয়েকে। মেয়েটিও তাকে ভালোবাসত।
ত্রিশ বছর আগেকার কথা। ধরেন তখন তার বয়স ২৩। আর মেয়েটার ১৭।
আচ্ছা।
মেয়েটার সঙ্গে তার পরিচয় হলো কীভাবে?
হোমিওপ্যাথি
ডাক্তার। ধরেন স্যার মেয়েটা তার মায়ের সঙ্গে এসেছিল ডাক্তারের কাছে। মায়ের হয়তো
খুব কাশি।
কিংবা
মেয়েটারই কাশি। অসুবিধা কী?
মানে
স্যার নায়িকা কাশি দিচ্ছে, এটা কি দর্শকেরা ঠিকভাবে নেবে?
আচ্ছা
ভেবে দেখি। তো মেয়েটার নাম কী?
জানি
না স্যার। আপনি একটা নাম দিয়ে দেন।
আমি
দেব। আচ্ছা ধরো দিলাম বর্ণালী চৌধুরী।
দিয়েন
স্যার একটা কিছু। আগে গল্পটা বলি। তো সেই মেয়ের সঙ্গে ডাক্তার আবুল বাশার বিএসসির
গভীর প্রেম। দুইজন দুইজনকে না দেখে একদিনও থাকতে পারে না। কথা না বলে থাকতে পারে
না।
বুঝলাম, প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি
অঙ্গ মোর অবস্থা। আর দুহু তরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া। এই তো।
জি
স্যার ধরেন।
তো
এই অবস্থায় মেয়ের বাবা চৌধুরী সাহেব টের পেয়ে গেলেন মেয়ের মন উচাটন। তিনি বললেন, খবরদার, আর কোনোদিনও ঘরের বাইরে যাবি
না। আমি শিগগিরই মাগুরার চৌধুরীর সেজ ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব।
মেয়ে
মুখে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। তলে তলে উপায় খোঁজে কীভাবে খবরটা আবুল বাশারকে
দেওয়া যায়।
তারপর
কাজের মেয়ের মাধ্যমে চিঠি লেখে। সেই চিঠি তার সইয়ের কাছে যায়। চিঠি নিয়ে সই যায়
আবুল বাশারের কাছে। আবুল বাশার সব ভাবে। তারপর বলে, কোনো রকমে তাকে বলো আমার কাছে
চলে আসতে। আমরা দেশান্তরী হব।
সই
ফিরে যায়। আবুল বাশার তার ঘরে ছটফট করে। সে রেডি হয়ে আছে। মেয়ে আসলেই তারা পালিয়ে
যাবে। মেয়েও চলে আসে। তখন রাত বাজে বারোটা। চারদিক নির্জন। কুকুর ডাকছে। দূরে
শেয়ালের ডাক। আর একটানা ঝিল্লিরব। এরই মধ্যে পায়ের আওয়াজ। মেয়ে এসে হাজির আবুল
বাশারের ঘর কাম চেম্বারে।
আবুল
বাশার তো রেডি হয়েই ছিল। গায়ে কোট। পরনে প্যান্ট। সে বলল, এসেছ। চলো। একটায় ট্রেন আছে।
আমরা চলে যাব। এই এলাকা ছেড়ে আমরা চলে যাব বহুদূরে। বিয়ে করব। ঘর বাঁধব।
মেয়ে
বলে, চলেন আগে পলাই।
আবুল
বাশার সাইকেল বের করে। সামনে বসায় মেয়েকে। সাইকেল ছুটছে। তারা পৌঁছায় যশোর
স্টেশনে।
এখনো
আধঘণ্টা বাকি। স্টেশনে প্ল্যাটফরমে সবাই তাদের দেখে ফেলতে পারে। তারা ওয়েটিংরুমে
বসে।
ট্রেন
আসে ১০ মিনিট আগেই। গাড়ির শব্দ পাওয়া যায়। আবুল বাশার তার জুতা খুঁজে পায় না। জুতা
খুলে সে চেয়ারে উঠে বসেছিল। জুতা গেল কই। জুতা গেল কই।
আসলে
জুতা জোড়া চুরি হয়ে গেছে। তারা যখন ঝিমাচ্ছিল তখন কোনো চোর এসে জুতা নিয়ে গেছে।
প্রায়ান্ধকার ওয়েটিংরুমের এ-চেয়ার ও-চেয়ারের নিচে আবুল বাশার জুতা খোঁজে। পায় না।
ট্রেন ছেড়ে দেয়। আবুল বাশার তখন খালি পায়েই তার প্রেমিকাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করেছে।
কিন্তু যখন গিয়ে পৌঁছায়, ততক্ষণে ট্রেন বিদায় নিয়েছে। ট্রেন ফেইল। এখন উপায়।
তারা
দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ঠিক এইসময় চৌধুরীবাড়ির লোকেরা এসে তাদের ঘিরে
ধরে।
মেয়েটিকে
নিয়ে যায় তারা জোর করে।
সেই
মেয়ের দেখা আবুল বাশার আর কোনোদিনও পায় নাই। এরপর থেকে আবুল বাশার আর কোনোদিনও
জুতা পরে না। কোটপ্যান্ট পরে। তবে জুতা না। আস্তে আস্তে তার মাথা আউলা হয়ে যেতে
থাকে। এখনো তাকে দেখা যায় যশোর রেলস্টেশনে।
যাহ্।
এখনো দেখা যায়?
জি
স্যার যায়।
তুমি
কেমনে জানলা?
আপনি
স্যার খোঁজ নেন। আপনাদের প্রতিনিধি আছে না যশোরে।
তা
আছে। আচ্ছা খোঁজ নিচ্ছি।
স্যার, মেয়েটা নাকি স্যার ভালোই আছে।
সুখে সংসার করতেছে মাগুরায়।
তুমি
কেমনে জানলা সুখে সংসার করতেছে নাকি দুখে।
তা
অবশ্য ঠিক। বাইরে থেকে দেখে তো আর বোঝা যাবে না।
তবে
আবুল বাশার লোকটাকে যেই দেখে তারই নাকি স্যার মায়া হয়।
হওয়ারই
কথা।
তো
স্যার আপনি গল্পটা লিখে ফেলেন। আমরা স্যার যশোর রেলস্টেশন থেকে শুরু করব। ক্রেন
নিয়ে যাব স্যার। টপ অ্যাংগেলে বার্ডস আই ভিউ দিয়ে শুরু করব স্যার।
তারপর...
অভিনয় করবে কে।
অভিনয়।
মোশাররফ করিম বা চঞ্চল।
নায়িকা?
তিশা
ভাবি হইতে পারে, নাকি
স্যার।
পারে।
লেখেন
স্যার।
তুমি
লেখো মিয়া। ট্রিটমেন্ট তো ভাইবাই রাখছ। কোথায় ক্যামেরা বসাবা তাও জানো। বানায়া
ফেলাও।
আপনি
লেখেন স্যার।
না
রে নাটক লেখা ছেড়ে দিছি। আজকাল আর ভালো লাগে না। তুমি লেখো। আমারে একবার দেখায়া
নিও।
ঠিক
আছে স্যার।
হিমেল
উঠে চলে যায়।
আমার
মনে হয়,
আমারও জীবনে জুতা
নিয়ে একটা ঘটনা আছে। আমিও তারপর থেকে জুতা পরি না। খালি স্যান্ডেল পরি। বিয়ে করতে
গেছলাম। পাঞ্জাবির সঙ্গে নাগরা জুতা ছিল। আগে থেকেই প্ল্যান ছিল জুতা খুলে রাখতে
হবে ভাগ্নের কাছে। তাকে পলিথিনের ব্যাগও দিয়ে রেখেছিলাম।
কিন্তু
জুতা খুলে বিয়ের আসরে বসেছি। কাজি আসবে। বিয়ে পরানো হবে। এমন সময় মনে পড়ল, জুতাজোড়া কই। ভাগ্নেকে ডেকে
বললাম, জুতা কই।
জুতা
লুকিয়ে রেখেছে পাত্রীপক্ষ। তারা কিছুতেই জুতা দেবে না। আমরাও জুতা না দিলে বিয়ে
পড়াতে দেব না। লেগে গেল ঝগড়াঝাঁটি। দুপক্ষেই রগচটা লোক ছিল। বংশ নিয়ে গালিগালাজ
শুরু হলো। শেষে আমার দুলাভাই আমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে চলে এলেন। বললেন, এই রকম ছোটলোকের ঘরে তুই বিয়ে
করতেই পারবি না।
বিয়ে
ভেঙে গেল। দু-চারটা নাক ও হাতও ভেঙেছিল। পুলিশ কেস।
এরপর
থেকে আমি আর জুতা পরি না।
মেয়েটাকে
খুব মনে পড়ে। তার সঙ্গে একদিন দুপুরবেলা চায়নিজ খেয়েছিলাম। সে আমার পাতে ভাত তুলে
দিচ্ছিল। তার গজদন্ত ছিল।
তাকেও
আমি আর কোনোদিন দেখি নাই।
চায়নিজ
খাওয়ার পরে বেয়ারা গরম পানির বাটি দিলো। লেবু দিলো। আমি তার হাত ধুয়ে দিয়েছিলাম।
লেবু কচলে কচলে। মেয়েটার নাক তখন খুব ঘামছিল। মেয়েটা তার স্বামীকে খুব আদর করে
নিশ্চয়ই।
এইসব
কথা হিমেলকে বলা যাবে না। তবে এই নাটক আমি লিখব না। আজকালকার ছেলেপুলে স্মার্ট
আছে। নিজেই নাটক লিখে ফেলে নিজেই ডিরেকশন দিতে পারে।
খালি
পায়ে ফিরেছিলাম বিয়েবাড়ি থেকে।
পরনে
শেরওয়ানি। পা খালি।
এই
কাহিনি কি আর আমি লিখতে পারি।
নিজের
কাহিনি লেখা যায় না। অন্যের কাহিনি লেখা যায়।