Thursday 27 November 2014

ছায়াশরীরি মা

শাওনীর ডায়রি থেকে ::

আমরা মানুষরা ক্ষণস্থায়ী। এই আছি তো, এই নাই! কেও মারা গেলে ধীরে ধীরে তার স্মৃতিটুকু ও মুছে যায়। অথচ মৃত মানুষটাকিন্তু পুরোপুরি হারিয়ে যায়না ! কোথাও না কোথাও থেকে যায়। হয়ত অন্য কোনরূপে, কিংবা অন্য কোন মাত্রায় ! কোন এক অতৃপ্ত আশা পূরণের অপেক্ষায়..মৃত্যুর পরে আরেক জীবন আছে, আমরা জানি। আর আমি জানি, সবচাইতে আপন, প্রিয়মানুষগুলোর দ্বিতীয় জীবন হচ্ছে আমাদের অনুভূতি। তারা আমাদের অনুভূতিতে মিশে থাকে। আমাদের বিশ্বাস আর অস্তিত্বে মেশে থাকে। যার সাক্ষী আমি..!!! কিছুদিন আগের ঘটনাই ধরুন...

(১)

ভার্সিটি ছুটি। তাই আমরা ৭ জন বান্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমরা ৭জন মানে-আমি, শাওলীন, সানতানা, সাকি, শুভ, অয়ন ও নিলয়। আমরা পুরাই এরকম টুর এ বের হই !আর এটা ছিল আমাদের চতুর্থ টুর। হঠাত্‍ করেই যাওয়া হয়েছিল, হয়তবা ভাগ্যেরটানে! আমাদের একটা অভ্যাস হচ্ছে, কোথায় গেলে সেখানকার অপ্রচলিত দুর্গম টাইপ জায়গা গুলোতে ঘুরে বেড়ানো। হাতে একটা ম্যাপ সংগ্রহ করে তাই সবাই মিলে জঙ্গলে জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম.. আর একপর্যায়ে নিজেদের আবিষ্কার করলাম, পুরনো বিরাট কোন এক জমিদার বাড়ির সামনে! বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাটাই শ্রেয়.. বিরাট বিস্তৃত দরজা, জানালা, গ্রিল দিয়ে ঘেরা ব্যালকনি । বাড়ির মুল দরজা, এতো সুন্দর আর সূক্ষ্ম কারুকাজ যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। সামনে এককালে বিরাট বাগান ছিল, তার নিদর্শন হিসেবে আগাছার রাজ্য উঁকি দিয়ে কয়েকটা গোলাপ গাছ এখনো নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করছে। পানির ফোয়ারা, বিশ্রাম নেয়ার জন্য এক একটা সেট ফলক..

বাড়ির সামনে পুরনো এক অশ্বত্থ গাছ, যেন ধ্যানমগ্ন বিজ্ঞ একটা প্রতীক.. গাছ টার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এই গাছ যদি কথা বলতে পারতো! তাহলে বাড়িটার ইতিহাস শোনা যেত.. শুভ কে দেখলাম একমনে ছবি তুলে যাচ্ছে, ও আমাদের গ্রুপের একমাত্র ক্যামেরাম্যান । ছবি তোলার হাত অসাধারণ, যেখানেই যাক গলায় তার DSLR একটা ঝুলবেই! অয়ন তো পুরাই মজা করে বলে, "শুভ কাপড় পড়া ভুলে যেতে পারে, কিন্তু এই ক্যামেরাখান গলায় ঝুলাতে ভুলবেনা!"

আমি অন্যদের দিকে নজর দিলাম, সাকি চশমা ঠিক করছে দাঁড়িয়ে। ও আমাদের গ্রুপের সবচাইতে ভাবুক, বিজ্ঞ একজন। ভীষণ গান পাগল ছেলেটা, শুভর গলায় যেমন DSLR, শাকির কাঁধে থাকবে গীটার, বাজাতেও পারে ভালো।

তুষার শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে নোটবুকে কি যেন লিখছে, নোটবুক আর একটা কলম তার সাথে থাকবেই! অয়ন কে কম্পিউটারের ম্যাজিশিয়ান বলা হয়, তাই আর ব্যাক-প্যাক এ ল্যাপটপ থাকবেই। সান্ত্বনা আর শাওলীন, কোথাও যাওয়ার আগে কসমেটিকের কীট সব একত্র করবে.. নাহলে নাকি ওদের চলেনা! আর আমি? প্রিয় ডায়েরি টা ছাড়া আর কিছু নিতে মনে থাকেনা আমার। . .

বেরসিক শাওলীনের চেঁচামেচিতে সবার ধ্যান ভাঙলো, এই মেয়ের গলার যে জোর ! কাউকে ঝাড়ি দিলে, সে আজীবন এই ঝাড়ি মাথা থেকে বের করতে পারবেনা!

"তোরা খেয়াল করেছিস, অন্ধকার হয়ে এসেছে ? যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে! কি করবো তখন আমরা ? কোথায় যাব ? এমনিতেই লোকালয় থেকে বহুদূরে আছি!"

অয়নও তার সাথে গলা মেলাল, ও শাওলীন এর অন্ধ সাপোর্টের! "আমার মনে হয় শাওলীন যৌক্তিক কথা বলছে, আমাদের এখনই কোন না কোন ব্যবস্থা নিতে হবে! আকাশের চেহারা মোটেও সুবিধের ঠেকছেনা.. মনে হচ্ছে ঝড় বৃষ্টি হবে !" আমি ভাবছিলাম, ওদের কিভাবে বলি যে.. আমরা পথ হারিয়েছি। হাতে যে ম্যাপটা অনুসরণ করে আসছিলাম ঘণ্টা খানেক আগ পর্যন্ত তার সাথে এই অংশটার কোন মিল নাই! এই বাড়ি কিংবা এর পাশের কোন উল্লেখ এ নাই ম্যাপ টি তে !!! সাকি চশমা ঠিক করতে লাগলো। এই ছেলের এই একটা মুদ্রাদোষ, কিছু বলারআগে চশমা ঠিক করা শুরু করবে! অবশ্য তার প্রস্তুতির মাঝেই নিলয় সমাধান দিয়ে দিল,

"বাড়িটাতে ঢুকি চলো। ঝড় বৃষ্টি থেকে বাঁচা যাবে অন্তত!" যেই ভাবা সেই কাজ, সবাই মিলে দরজাটা ঠেলতে লাগলো। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। ওদের সাথে হাত লাগাচ্ছিনা। অপরাধবোধে ভুগছি আসলে! কেন সবাইকে এর আগেই জানালাম না যে,আমরা অপ্রচলিত এমনকি ম্যাপ এর বাইরের কোথায় এসে হাজির হয়েছি.. এখন ফিরব কি করে ! সাথে খাবারও নাই পর্যাপ্ত, টিকে থাকব কি করে এখানে ? এদিকে ৬ জনের ঠেলাঠেলিতে ও দরজা একচুল নড়ল না, বেচারাদের উৎসাহে ভাটা পড়লো ! অবাক হলাম, এতোজনের শক্তিতেও দরজাটা নড়বেনা কেনো? আনমনেই যেন বলে ফেললাম, "দরজাটা হয়ত ধাক্কা দিয়া নয়, টেনে খুলতে হয়!" "এসো বুড়ি, তুমি নিজে ট্রাই করেই দেখ না!" শুভ চোখ নাচিয়ে বলল । শ্রাগ করে এগিয়ে গেলাম, দরজার হাতল ধরে ছোট্ট একটা চাপ ফেললাম। হাতের তালুতে সূক্ষ্ম কোন খোঁচা অনুভূত হল! পাত্তা না দিয়ে হাতল ধরে দিলাম হালকা এক টান্‌.. জানতাম আমার এই হালকা টানে কিছুই হবেনা..

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য,আমাদের ৭ জোড়া চোখের সামনে হুট করে খোলে যায় দরজাটা। পরে অবশ্য জেনেছিলাম,উনিশ বছরের বন্ধ দরজা এই প্রথম আমি এ খুলেছি। সাথে খুলেছিলাম,উনিশ বছর আগে চাপা পড়ে যাওয়া অনেক নির্মম মর্মান্তিক এক রহস্য সমাধানের পথ।



(২)

সানতানা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,"আমি জানতাম শাওনী পারবে। কোন প্রবলেমে ওর কাছে প্রবলেম না।" এই মেয়েটা কেন জানি আমাকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করে! হতাশ সঙ্খা আর উচ্ছ্বাস দেখলাম। ও যখন জানবে, এই জঙ্গুলে বিদঘুটে জায়গায় এভাবে হঠাৎ আটকে পড়ার কারণটা শুধুমাত্র আমি, তখন আর মনের অবস্থা কি হবে! বেশিদূর ভাবার সুযোগ পেলাম না।কারন সাকি চশমা ঠিক করে নিয়ে বললো...

"একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ,তোমরা?"

"কি"

কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইলাম।

"তোমরা যারা এ দরজার হাতলে হাত দিয়েছ,তাদের সবার হাতে একফোঁটা রক্ত।"

শাওলীন,অয়ন দুজন এ অবাক হয়ে যার যার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল।

"রক্ত এলো কোত্থেকে?"

"নিজেদের তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কিভাবে... মানে টের পেলাম না কেন ? আর রক্তটা ও জমাট বাধছেনা কেন?"

সাকি আমার হাত তুলে ধরে বলল,

"তোমার হাতেও আছে, শাওনী!"

"পুরানো দরজা,তাই হয়তবা কিছু একটার খোঁচা লেগেছে.. বাড়িটা পরিত্যক্ত কিনা কে জানে!"

"মোটেও পরিত্যক্ত না,ভিতরে এসে দেখে যাও!"

জবাবটা নিলয় ভিতর থেকে দিল।

সান্ত্বনা, শাওলীন আর আমি সাথে সাথেই ঢুকে পড়লাম।শুভ অশ্বত্থ গাছে বসে থেকে বিরাট এক বাজপাখির ছবি তুলেছে! অবাক হয়ে বাজ পাখিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, এত বড় বাজপাখি আগে দেখেছি বলে মনে পড়েনা! বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়েতে যাব,মনে হল কেও একজন তাকিয়ে আছে.. আশপাশ দেখতে লাগলাম,মনে হল অশ্বত্থ গাছের পেছনেকেও একজন আছে! দাঁড়িয়ে রইলাম সেদিকে ফিরে, হটাৎ সাকি এসে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। একগাদা অস্বস্তি নিয়ে ওর সাথে গেলাম, একবার পিছু ফিরলাম। অস্বস্তি কমলনা,বরং বাড়ল! দেখলাম এলোমেলো চুলের এক লোক দাঁড়িয়ে আছে.. হিংস্র কোন এক অভিব্যক্তি তার চোখেমুখে । একবার দাঁড়িয়ে আবার তাকালাম, কেও নাই! বাড়ির ভেতরে বিরাট বড় এক ঝাড়বাতি জ্বলছে,কোথায় যান্ত্রিক একটা শব্দ ও শোনা যাচ্ছে মনে হল..

আমার ভুলও হতে পারে ! আর ঝাড়বাতির আলোয় চারপাশ অপার্থিব লাগছে। পুরনো এবং অবাক হওয়ার মতো অলংকরণ, জিনিসপত্র। নিলয় তখন ও বলে চলল, "পরিত্যক্ত হলে বাতি কিভাবে জ্বলল? কে জ্বালাল? নিশ্চয় কেও আছে, কিংবা থাকে!" শাওলীন আর সানতানা ভয়ে ভয়ে চারপাশ দেখতে লাগল, ওরা আবার ডিজিটাল ভুতে বিশ্বাসী। নিয়ম করে ভূত এফ.এমশোনে আর ঘুমের মাঝেও ভয় পায়!"আমার ভয় লাগছে, চল এখান থেকে চলে যাই!"কিন্তু ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আরবাতাসের টানে হটাৎ দরজাটা ও বন্ধ হয়ে গেল!অয়ন আর শুভ মিলে দরজায় খিল এঁটে দিল।"যাক বাঁচলাম ঝড় বৃষ্টি থেকে। সব ঠিক আছে. তবে সাথে কয়েকটা চিপস আর বিস্কিট এর প্যাকেট ছাড়া খাবার কিছু নাই, এই যা! তাছাড়া পুরনো বাড়ি আমার একদম পছন্দ না। কেমন যেন দুঃখ দুঃখ ভাব আর প্রচুর ধুলা"  "কিন্তু এখানে ধুলো নাই, এক বিন্দু ও না! যেন কেও নিয়মিত পরিষ্কার করে.. আর আমার পুরনো বাড়ি অনেক ভাল লাগে।" বলে কারো কোন মন্তব্যের অপেক্ষা না করোই, আমি বাড়িটা ঘুরে দেখতে শুরু করে দিলাম..

কি সুন্দর সাজানো গোছানো চারপাশ। ভারী আসবাবপত্র,দামি খাটের টেবিল,চেয়ার,শেল্ফ,ইজি-চেয়ার,দেয়ালের কারুকাজ গুলো এক কোথায় অসাধারণ। আর আছে দেয়ালে বিশাল আকারের সব পোর্টেইট। একেকটা এতোই বিশাল যে,সামনে দাঁড়ালে কেমন যেন লাগে! পোর্টেইট গুলো নিশ্চয় এই বাড়ির বাসিন্দা কিংবা তাদের পূর্ব-পুরুষদের। কি আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্ব ছড়ানো সেগুলোয়। প্রতিটি নারী-পুরুষের মাঝে। মনে হল শিল্পী তার সমস্ত নৈপুণ্যটা তুলে ধরেছে.. এতো জীবন্ত সেগুলো, মনে হচ্ছে এই বুঝি আড়মোড়া ভেঙ্গে প্রশ্ন করে বসবে,"তোমরা কারা?" পোর্টেইটগুলো দেখতে দেখতে দো-তলায় পৌঁছলাম। সেখানে আলো আঁধারির মাঝে আরেকটা রয়েছে। . .

ভালো করে দেখার জন্য সেল ফোন এর আলো ফেললাম। .একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা ঋজু ভঙ্গিতে আসন নিয়েছেন,চোখে মুখে এত্তো মায়া তার। মনে হল এক্ষুনি বুঝি পিটপিট করে চাইবেন।আর তাতেই আটকে রাখা কান্না ঝড়ে পড়বে! ভীষণ পরিচিত ঠেকলো এই ভঙ্গিমা,চোখ দুটো। কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই চোখ গুলোর উপর হাত ভোলাতে লাগলাম।

দূর থেকে কেও দেখলে হঠাত্‍ ভাববে আমি বুঝি পরম মমতায় পোট্রেট এর মহিলার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছি! সাকি পেছন থেকে নরম গলায় জানতে চাইল, "কি হয়েছে শাওন ?" "কোথায় যেন দেখেছি, এ মহিলা কে! মনে পড়ছেনা.." ঠিক যেন ঘরের মাঝ থেকে জবাব দিলাম, মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছি তখন ও প্রাণপণে। "তোমার চেহারার সাথে অসম্ভব মিলও। . . তাই না? মনে করিয়ে দেই, কোথায় দেখেছ,উনাকে?" "হুম... দাও।" "শাওন, তোমার গলার লকেট টা খুলে মিলিয়ে দেখ! ঠিকই মনে পড়ে যাবে । ভীষণভাবে চমকালাম! মনে হল নড়তে ও পারব না। কাঁপা হাতে লকেটটা খুললাম। "এ কি করো সম্ভব?"লকেটের ভিতর একজন নারী ও পুরুষ রয়েছেন! মনে হল পুরুষটার পোট্রেট ও দেখেছিলাম দেয়াল এ! আমি এদের চিনিনা,জানিনা! সেই ছোটকাল থেকেই বিরাট আকারের এই লকেট আমার গলায়!আমি মানুষ দুটোকে চিনিনা,জানিনা।অথচ ছোটকালে যখন খুব একা লাগত,ছবি দুটোর সাথে কথা বলতাম। আর শান্তি পেতাম, কে জানে কেন!আজ জানলাম ওরা এখানকার.. তাহলে আমার লকেট এ তাদের ছবি কেন! .. বন্ধুরা এসে হাজির হাওয়ায় লকেট বন্ধ করে ফেললাম।স্বাভাবিক হতে চাইছি,কাউকে বুঝতে দেয়ার ইচ্ছে নেই!

"শাওনী, বাড়িটা তে এত খুঁজে ও কাউকে পেলাম না! এমনকি কারো এখানে বসবাস করার চিহ্ন ও নাই! অথচ দেখ,বাড়িটা পরিত্যক্ত না! পরিষ্কার, সাজানো, গোছানো!" শুভর কণ্ঠে নিখাদ বিস্ময়। সানতানা ভয়ে ভয়ে চারপাশ দেখল কিছুক্ষণ। "কেও না থাকলে,বাতি জ্বালাল কে বল তো?" "আর বাড়িটা অত নিপুণভাবে পরিষ্কার ই বা রাখে কে?" "আর অমন একটা জঙ্গুলে জায়গায়,এত বিশাল বাড়ি.. দামী আসবাবপত্রে ভর্তি.. চুরি যাওয়ার ও ভয় নেই নাকি?

সাকি চুপচাপ সানতানা, শাওলীন,শুভ আর নিলয় এর কথা শুনছিল। "এখানে আসার আগে এক বৃদ্ধে সাথে দেখা হয়েছিল,মনে আছে?কোন এক জমিদারবাড়ির কথা বলছিল," আমরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম, বৃদ্ধটাকে ভুলা অসম্ভব!প্রথম দেখায় যে কেও তাকে পাগল ভাবলেও,আমি বলব তিনি অসম্ভব জ্ঞানী একজন মানুষ!এখন মনে পড়ছে,এদিকে আসার কথা উনিই বলেছিলেন আমাদের! বলছিলেন,এদিকে খুব সুন্দর একটা জায়গা আছে! কিন্তু এটা বলেন নি যে, সেই বাড়িটা আমরা পথেই পাব! "এটাই সেই জমিদার বাড়ি, যেটা গত উনিশ বছর ধরে পরিত্যক্ত! এখানে কেউ থাকেনা ! থাকবে কি করে? হাজার চেষ্টা করেও এর দরজা গত উনিশ বছর কেউ খুলতে পারেনি! অথচ অনেকেই চেয়েছে। এটাই আশফাক-খাঁর আশ্চর্য মঞ্জিল! প্রচলিত আছে, এই বাড়ি তার উত্তরাধিকারীর জন্য গত উনিশটা বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে! বলে যায়.." সাকি লেকচার থামিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি.. "দরজা টা খুলে, তুমি কিছুক্ষণ আগে একটা ইতিহাস গড়ে ফেলেছ,শাওন! তাহলে তুমিই কি . . . " তার কথা অসমাপ্ত থেকে যায়,মূল দরজায় জোরে কশাঘাতের শব্দে!কে যেন শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে মূল দরজা ধরে নাড়ছে। বেপরোয়া ভাবে, যেন তার ভেতরে আসতেই হবে!!



(৩)

আমরা সবাই তাড়াহুড়া করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছি। কে আসলো এই সময়?এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে?হঠাৎ বিকালের সেই এলোমেলো চুলের লোকের কথা মনে পড়ে গেল! লোকটা কে আমার মোটেও সুবিধের কিংবা ভালো লাগেনি। শাওলীন আর সানতানা আমার দু পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো।ওদের হার্টবীট শুনতে পাচ্ছি আমি । শুভ, অয়ন কাছাকাছি রয়েছে। কেমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! হয়ত পরিবেশের কারণেই মনের উপর চাপ পড়ছে।সাকি খিল খুলতে এগিয়ে গেল,নিলয় তাকে সাহায্য করবে। শাওলীন, সানতানা আমার দুহাত চেপে ধরেছে এখন। ওদের ভয় কিছুটা আমার মধ্যেও সঞ্চার হলো.. সাকি দরজার খিল খুললে ও,দরজা খুলতে পারলো না। সে আমার দিকে ফিরল,নীরবে মাথা নাড়ে ।

আমি এগিয়ে গেলাম। হাতল ধরার সাথে সাথেই সেই একই খোঁচা,তারপর দরজা খুলে গেল। আর আমরা সবাই আগুন্তুক কে দেখতে পেলাম! খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়ে আর বিরাট ঘোমটা মুখের উপর টেনে দেয়া এক মহিলা! এতো রাতে উনি এই জঙ্গলে জায়গায় কি করতে এসেছেন?মহিলার হাতে বড়সড় একটা ঝুড়ি..সেটা ধরে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে বুঝে গেল! তাই নামিয়ে রাখলেন ঝুড়িটা। . তারপর নীরবে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, ঘোমটার আড়াল থেকে তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি অনুভব করতে পারলাম,তবে অস্বস্তি বোধ হলো না! আমরা হা করে তাকিয়ে আছি, এতো রাতে একজন মহিলা এমন একটা বেঢপ সাজ আর ঝুড়ি নিয়ে কি করতে বেরিয়েছে? কোন ব্যাখ্যা ই মাথায় আসল না! সবাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি,কারো মুখেই কথা নাই। শুধুমাত্র বাইরে একটানা ঝড় বৃষ্টির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে!সাকি,নিলয় দরজায় আগের মত খিল এতে ফিরে এল । তারা ও আমাদের মত অবাক হয়েছে বুঝতে পারলাম।এদিকে ঘোমটায় ঢাকা আগুন্তুক মহিলা টি ও যে অস্বস্তি তে আছেন,তাই সহজেই অনুমেয়। মনে মনে প্রার্থনা করলাম,কেউ একজন যেন দয়া করে এই নীরবতা ভাঙ্গে! অসহ্য লাগছিল। আমার প্রার্থনার জবাবেই যেন নিলয় প্রথম কথা টি বলল.. "জি,আপনি?এতরাতে.. আমরা ভেবেছিলাম এই বাড়িতে কেও থাকেনা।" "ঠিক ই ভেবেছ বাবা.. এই বাড়িতে কেও থাকেনা!" "তাহলে আপনি.." "মানে আসলে আমিই বিকাল থেকেই এই জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি । "আপনার সাথে আর কেও নাই?" অস্বস্তি কাটিয়ে জানতে চাইলাম। "না মা,আমি একা।একা একা নিজের মত করে থাকি, সবচাইতে কাছের গ্রামটি তে।আজ একটু বিপদে পড়ে গেছি। সেই বিকাল থেকেই দিশেহারার মত পথ খুঁজছি । তোমরা কি রাত টা থাকার মত একটু জায়গা দেবে?আমার তাহলে বড্ড উপকার হয়!" "কেন নয়?আমাদের দিক থেকে আপত্তি.." বন্ধুদের সমর্থনের আশায় তাদের দিকে ফিরলাম। কারো অসম্মতি নাই। শুধু সাকি কে দেখলাম নীরবে কি যেন ভাবছে! "আমাদের দিক থেকে আপত্তি নাই, আর বাড়িটাও ফাঁকা অতএব কোন বাসিন্দাও বাগড়া দিতে আসবে বলে মনে হয়না!" "আমি তো সেটাই বলতে চাইছিলাম তখন।এই বাড়িতে..." সাকি কে কথা বলার সুযোগ না দিয়া তিনি বলেন, "তোমার অনুমতি পেলেই চলবে। মানে তোমাদের এ কয়জনের আর কি!" "সানন্দে থাকতে পারেন আপনি! তবে আমাদের সঙ্গে দু এক প্যাক বিস্কিট আর খাবার পানি ছাড়া কিছু নাই। এগুলো দিয়েই আজ রাত টা পার করতে হবে,পারবেন?" তিনি মৃদু হাসলেন।

আমি অবাক হয়ে গেলাম,এতো সুন্দর করে কেও হাসতে পারে! আর গলার স্বর.. এতো মায়া মাখানো! "চিন্তার কিছু নাই,আমার ঝুড়িতে অনেক খাবার আছে! তোমরা সবাই তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারবে! কি,খাবে ? তাহলে আমাকে ফিরার সময় এই ঝুড়ি বাড়ি বইয়ে নিয়ে যেতে হবেনা!" "আপনাকে ধন্যবাদ।দয়া করে যদি কিছুর বিনিময়ে...." "কিছু লাগবেনা,তবে নিতান্তই যদি দিতে চাই.. তাহলে একটা জিনিস চাইতে পারি।" "নিঃসংকোচে বলুন,আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো দিতে।" তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন যেন কথা গোছাচ্ছেন। অস্বস্তি বোধ করছেন হয়ত। কিন্তু আমার মনে হলো তিনি কাঁদছেন! কিংবা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন।কারণ তার পরবর্তী কথাগুলো কিছুটা ভারী শোনাল। "তুমি আমাকে... মা ডাকবো? খুব অল্প কিছু সময়,ধর আজ রাত টার জন্য।" আমি কল্পনা ও করতে পারিনি,ভদ্রমহিলা এমন একটা কিছু চাইবেন!

সবকিছু কেমন যেন লাগছিল। মনে হচ্ছিল,আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাব।গলার কাছে কষ্টগুলো এসে জমা হচ্ছে।হয়ত ভেঙ্গে পড়তাম তখনি।কারণ গার্লস হোস্টেল আর উইমেনস হোস্টেলে অসহায়ের মত বেড়ে উঠা, বাবা-মা হারা একটি মেয়ের কাছে আজ পর্যন্ত কেউ এমন আবদার করেনি! মামা-মামি শুধু দায়িত্ব পালন করে গেছেন এ পর্যন্ত। কখনো কাছে বসিয়ে নরম স্বরে কিছু জানতে চাওয়ার সুযোগটুকু হয়নি তাদের!

সানতানা আমার এক হাত তার হাতে পুরে নিল,মন খারাপ টের পেয়েছে। এই বন্ধুগুলা কখনোই আমার সঙ্গ ছাড়েনি। সে স্কুল জীবন থেকে এ পর্যন্ত পাশে ছিলো,আছে,থাকবে ও। প্রতিটি ব্যাপারে অন্ধ সমর্থন দিয়ে গেছে! সানতানার হাতের উল্টো পিঠে মৃদু চাপ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। "আমার না 'মা' নাই। মামা-মামির দায়িত্বে বড় হয়েছি। গার্লস হোস্টেলের সুপার,কিংবা রুমমেট- ওদের নিয়েই আমার পরিবার । আর আছে,সবসময় পাশে থাকে এই সাতটা বন্ধু। কখনো কাউকে মা কিংবা বাবা ডাকার সুযোগ হয়নি আমার।শব্দ দুটোর সাথে পরিচয় ও নাই। 'মা' 'বাবা' কেমন হন, কি করেন,কি বলেন,সন্তানের সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন হয় আমি সত্যি জানিনা।জানিনা মায়ের ঘুম পাড়ানি গান কেমন হয়! বাবার বন্ধুত্ব কেমন হয়.." কিছুটা থামলাম,আজ এতো কষ্ট লাগছে কোনো কে জানে! শাওলীন পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলো। "মায়েরা হয়ত এঞ্জেল টাইপ হোন,কিংবা আমার এই বান্ধবী দুটোর মত...

শত কষ্টেও যারা ঘিরে থাকে,আগলে রাখে আমাকে। আর ঐ পাগলা ৪ টার মতো নিশ্চয়ই হোন বাবারা,প্রাচীন শক্ত মজবুত কোন বৃক্ষের মতো। হাজার প্রতিকূলতায় ও আমার মাথার উপর একটা আশ্রয়,পরম নির্ভরতা.... আমি দুঃখিত,অনেক কথা বলে ফেললাম। আসলে কেউ কখনো 'মা' ডাকার সুযোগ দেয়নি তো, তাই আবেগের বসেই........ আপনাকে 'মা' ডাকতে আমার আপত্তি নাই। বরং অনেক ভালো লাগবে। অনেক বেশীই ভালো লাগবে..." ঠোঁট কামড়ে অনেক কষ্টে কান্না ঠেকালাম। বুঝতে শেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত,কখনো কাঁদিনি। আবেগশূন্য একটা মেয়ে আমি। অথচ আজ এতো কান্না পাচ্ছে কোনো, কে জানে! তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন । তারপর হঠাৎ জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আর পারলাম না,নিয়ন্ত্রণ রাখতে! কেঁদে ফেললাম।কখনো এভাবে অতি মমতায় কেও জড়িয়ে ধরেছিল কিনা মনে নাই। ভেতরের কষ্ট গুলো বেরিয়ে আসছিল একে একে.. বছরের পর বছর জমা হয়ে কষ্ট সংখ্যা নেহাত কম নয়! আমি মা কে ধরে অনেক্ষণ কাঁদলাম। হালকা হলাম বলতে হবে। আর তিনি পুরোটা সময় আমার পিঠে হাত বুলিয়ে গেলেন। নীরব সান্ত্বনা।



(৪)

জানিনা এভাবে ঠিক কত টা সময় ধরে কেঁদেছি।যখন আমার ঘোর কাটলো,উনাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।র উনি পরম মমতায় চোখ মুছে দিলেন। ছোটকালে একবার মামার বাসায় সিঁড়ি থেকে পরে গিয়া পা ভেঙ্গেছিলাম।রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিলাম কিছুক্ষণ,তবু কাঁদিনি.. চিৎকার তো দূরের কথা। কারণ আমার মনে হত- আমার এমন কেউ নাই যে আমাকে সান্ত্বনা দেবে। ভেকেশান গুলোতে অনেকটা বাধ্য হয়েই মামা-মামির কাছে আসতাম। আর সেখানে পা ভাঙ্গা টা ভারী ঝামেলার ছিল! পরে শাওলীনের আম্মু জোর করে উনাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি না কাঁদলে কি হবে? শাওলীন পাগলী টা একনাগাড়ে দু দিন আমার পাশে বসে কেঁদেছে, আর তাকে সংগ দিয়েছে সানতানা! আমি তখন উল্টো ওদের সান্ত্বনা দিয়েছিলাম।কি অদ্ভুত! ঐ তো এখন ও দুই গাধী কাঁদছে, পারে ও তারা! মা আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, "এসো,খাবার বেড়ে দেই । তোমরা নিশ্চয় অনেক ক্ষুধার্ত!" ঝুড়ির দিকে এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন,পেছনে ফিরে আমার কপালে চুমু খেলেন ঘোমটার আড়াল থেকে । তারপর খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।খাওয়ার সময় মা সবার পরিচয় জানলেন, খুঁটি-নাটি প্রশ্ন করলেন। আমার মনে হল উনি পরখ করে নিলেন আমাদের বন্ধুত্ব । নিজের সম্পর্কে বেশী কিছু বললেন না।শুধু জানতে পারলাম,ছোটকালেই তার মেয়ে হারিয়ে গেছে।আজকের এই দিনে তার মেয়ে তাকে প্রথম 'মা' ডেকেছিল । তাই প্রতিবছর এই দিনে তিনি নিজ হাতে খাবার বানিয়ে গ্রামের বাচ্চা গুলোকে খাওয়ান। আর আজ পথ হারানোয় তার সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো।

মা আর কিছু বললেন না, নীরবে আমাদের খাওয়ার তদারকি করলেন।এমনকি আমাকে একবার খাইয়ে ও দিলেন। কিন্তু নিজে খেতে রাজি হলেন না, ঘোমটা ও খুললেন না । আর আমরা কেও ও জোর করিনি। থাকুন না,উনি নিজের মতো করে! খাওয়া শেষে ওরা পছন্দ মতো জায়গা বেছে নিল বিশ্রামের জন্য। সাকি আর নিলয় এক ঘরে, আয়ন আর শুভ নিল একটা। আর আমরা বাকিরা অন্য একটা। ঘরগুলো অনেক বড়,বিরাট দুটো জানালা,দুটো দরজা। একটা দরজা দিয়ে বাড়ীর ভেতর যাওয়ার জন্য,অন্য টা দিয়ে গেলে গ্রিল-ঘেরা ব্যালকনি .


সাকি কে দেখলাম, গীটার নিয়ে জানালার পাশে বসলো, কিছুক্ষণ টুং-ঠ্যাং করবে। এটা অর অভ্যাস, রাতের বেলা কিছুক্ষণ গীটার নিয়ে পড়ে থাকে! আমি,শাওলীন আর সানতানা মাঝের একটা ঘর বেছে নিলাম। এই ঘরটা অন্য গুলোর চাইতে বিশাল এবং এর আসবাবপত্র গুলো ও আলাদা। যেন খুব বিশেষ একটা ঘর.. বিছানার চাঁদরে কেমন যেন একটা মায়াবী গন্ধ,আমি সবকিছু ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। . .

কল্পনায় কতো কিছু ভেসে উঠতে লাগলো। এই ঘর টা হয়ত কারো পারিবারিক ঘর ছিল। আজ তারা নেই..মহিলা টা নিশ্চয় এই জানালার ধারের টেবিল এ বসে লিখত,কিংবা ছবি আঁকত। কখনো রাত জেগে গল্প করতো,স্বামীর সাথে . . মা শুয়ে পড়তে তাড়া দিলেন,আমি চুপচাপ মেনে নিলাম।অন্য দুজন ও! শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম,বড্ড ক্লান্তি লাগছে। মাথায় কার স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখলাম,মা চুলে বিলি কাটছেন। "মা,একটা কথা বলি?" "বলো!" "এই বাড়ীটা কাদের? কারা ছিলেন?" "সব জানতে পারবে,হয়ত আজ রাতের মাঝেই। . . এখন ঘুমাও" "কিভাবে জানব?" "সময় হলে টের পাবে, ঘুমাও তো!"

এমন একটা মিষ্টি ঝাড়ির জন্য কতোটা বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি..চোখ বন্ধ করে,মায়ের চুড়ির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম । তবে ঘুম ভালো হলো না মোটেও! দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। ছবির মহিলাটি একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়চ্ছেন, তার সারা শরীর রক্তাক্ত। সুন্দর বড় চোখ বেয়ে কান্না ঝরছে। তিনি দিশেহারা হয়ে দৌড়চ্ছেন আর দৌড়চ্ছেন! এবার দেখলাম আমার মাথার কাছে বসে মা কাঁদছেন। মুখের উপর ঘোমটা নেই, দেখতে হুবহু সেই মায়াবী মহিলাটির মতো।

পাশে দাঁড়িয়ে এক লোক, তাকে কোথায় যেন দেখেছি স্বপ্নে তা মনে করতে পারলাম না! লোকটি মা মানে পোট্রেট এর এই মহিলা কে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না, শুধু কাঁদছিলেন আমার দিকে তাকিয়ে। যেন আমার জন্য তার খুব মায়া হচ্ছে! যেন... আমিই তার হারানো সেই শিশুটি!

এবার দেখলাম এক মধ্যবয়স্ক লোকের নেতৃত্বে বাঁশ নিয়ে কয়েকজন ভয়ংকর চেহারার মানুষ বাড়ীটার সামনে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টির মাঝেও তারা কি দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে! তাদের মাঝে বিকালের সেই রুক্ষ চেহারার লোক টিও রয়েছে। অবাক হয়ে গেলাম।কারণ আমি তাদের অভিব্যক্তি টের পাচ্ছি। মুখগুলোতে হিংসা, ক্রোধ আর লোভ ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতির ছিটেফোঁটা ও নেই! আমি তাদের খুব কাছে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম. এতোই কাছে যে, তাদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মনের কথাগুলো ও পড়তে পারছিলাম! সবার মনে একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, "উত্তরাধিকারী এবার বেঁচে ফিরতে পারবেনা!" দৃশ্যপট আবার ভিন্ন।

ঝকঝকে দিনের আলোতে আমি বাড়ীটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।বাগানে,বাড়ীর দরজায়,আশেপাশে অনেক মানুষ। অনেক হৈচৈ! কেউ একজন চেঁচাতে চেঁচাতে আমার পাশ দিয়ে গেল, "জমিদার আশফাক-খাঁ এর মেয়ে হয়েছে!" তারপর দেখলাম সেই মায়াবতী মহিলা তার বাচ্চা কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে সান্ত্বনা দানকারী লোক টা। কেউ একজন এসে অভিবাদন জানিয়ে গেল,জমিদার আশফাক খাঁ কে।অবাক হয়ে দেখলাম,অভিবাদনকারী কে! সেই মধ্যবয়স্ক লোক যে কিনা বৃষ্টি মাথায় দাঁড়িয়েছিল বাড়ীর উত্তরাধিকারীর প্রাণ নাশের উদ্দেশ্যে! দৃশ্যপট বদলে গেল দ্রুত।জমিদার আশফাক খাঁর নিথর দেহ পড়ে আছে মেঝেতে। অনেক অনেক রক্তের মাঝে! পিচ্ছি এক মেয়ে হামাগুড়ি দিয়া আসে আশফাক খাঁর দাঁড়ি ধরে টানতে লাগলো.. আর ডাকতে লাগলো, "পাপ্পা... পাপ্পা... পাপ্পা.." ঘুমের মাঝেও আমার কান্না পেলো, কি মর্মান্তিক!

সাকি জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছিল, ঘরের বাতি নেভানো। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় কিছু নড়াচড়া চোখে পড়ল তার। অনেকগুলো মানুষ বাড়ীটির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাকি বুঝতে পারল,লোকগুলোর কোন উদ্দেশ্য আছে! আর সেটা সৎ নাকি অসৎ তা বুঝার জন্য সে জানালা বন্ধ করে ব্যালকনি তে চলে গেল। একটি থামের আড়ালে লুকিয়ে বসলো,লোকগুলোর গতিবিধি জানা দরকার! তাদের অনুপ্রবেশকারী ভেবে রেগে নেইতো,এরা?যদি রেগে নাই বা থাকবে,হাতে ওরকম অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে কেনো বেরিয়েছে এমন ঝড়ের রাতে? সে একবার ভাবলো, ভেতরে গিয়ে সবাইকে দেখে তুলে দেবে। যাতে সতর্ক থাকা যায় ।পরক্ষণেই চিন্তাটা নাকচ করে দিল,দেখাই যাক না কি হয়! দরকার পড়লে তখন ব্যবস্থা নেয়া যাবে ।

নিজের ভাবনায় মগ্ন থেকে, সাকি খেয়াল করলো না লোকগুলোর মাঝে চঞ্চলতার উদ্ভব হয়েছে! সে দেখতে পেলো, তারা একে অন্য কে অশ্বত্থ গাছটির দিকে হাত নেড়ে কিছু দেখাচ্ছে। আর উত্তেজিত ভঙ্গিতে কি যেন বলাবলি করছে! বিদ্যুতের পরবর্তী জলকে সাকি ও দেখতে পেলো দৃশ্য টা! অদ্ভুত,অবিশ্বাস্য সাকির জীবনে দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত দৃশ্য..

এলোচুলের এক নারী অশ্বত্থ গাছটির উঁচু মতো এক ডালে দাঁড়িয়ে আছে। দুহাত দুদিকে ছড়ানো, বাতাসে তার চুল উড়ছে,আঁচল উড়ছে। বৃষ্টি যেন তাকে ছুঁতেও পারছেনা!হঠাৎ কি হল,কে জানে! লোকগুলো মাটিতে দেবে যেতে লাগলো, যেন চোরাকাদায় পা পড়েছে। আর সেই কাদা ওদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার, চেঁচামেচি, আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো! তারপর সব শেষ। কেউ নাই সেখানে,কারও কোন চিহ্ন নাই! কোন শব্দ কিংবা অস্তিত্ব ও নাই। সব যেনও ভোজবাজির মত বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

সাকি সম্মোহিতের মত দাঁড়িয়ে রইল। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখায় ও কখনোই বিশ্বাসী না... তাহলে কি ছিলো একটু আগের দৃশ্যটা?এতোগুলো মানুষ কোথায়ই বা গেল?



(৫)

সকালে বেশ দেরিতেই ঘুম ভাঙলো আমার,সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখে কাটিয়েছি। বসে বসে সেগুলো মেলানর ব্যর্থ চেষ্টা চালালাম।সব ভাবতে লাগলাম, মেলাতে লাগলাম একসাথে। স্বপ্নগুলো এতোটাই জীবন্ত ছিলো যে, স্বপ্ন হিসেবে ভাবতে পারছিলাম না! সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল আমার।মনে হল মাকে খুব দরকার এখন।উঠে খুঁজতে লাগলাম তাকে। কিন্তু... মা নাই! এ ঘর, ও ঘর, ব্যালকনি,হেন,কোন জায়গা নাই যেখানে মাকে খুঁজি নাই . . .

শূন্য লাগছিল খুব,কেমন যেন শূন্যতা চারপাশে! আগের ঘরটায় ফিরে এলাম।আমার বালিশের পাশে চামড়ায় বাঁধানো একটা ডায়েরি, কিছু কাগজপত্র। কৌতূহল হল, খুলে পড়তে লাগলাম।হঠাৎ মনে হল জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা জানে ফেলেছি! ভাগ্য যে জন্ম থেকেই আমার বিরুদ্ধে আজ পুরোপুরি তা জেনে গেলাম। গত রাতের স্বপ্নগুলো ও মিলে গেল এক নিমেষে! আর আমি বড় একটা ধাক্কা খেলাম..

বন্ধুরা সব উঠে পড়েছিল বহু আগেই! বাড়ীর ভেতরের একটি কুয়া থেকে পানি তুলে ফ্রেশ হয়ে বাড়ী টা ঘুরে দেখলো দিনের আলোয়। ওরা ভেবেছিল আমি ঘুমচ্ছি, তাই বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে দেখতে আসছিল আমাকে । ঠিক কতক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করছিলো,আমি বলতে পারবো না। পরে শুনেছিল আধা ঘণ্টা সবাই মিলে আমাকে খুঁজেছে। সাকিই প্রথম আমাকে আবিষ্কার করে একটা ঘরে। যেখানে আমি ঐ মায়াবতী মহিলার একটি পারিবারিক পোট্রেট কোলে নিয়ে বসে ছিলাম। আসলে আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ছবির ছোট্ট শাওনি আর এই আমার মধ্যে ঠিক কতটা মিল কিংবা পার্থক্য!!

সাকি যখন আমার পাশে এসে বসলো,আমি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। পোট্রেট টা দেখিয়ে জানতে চাইলাম,"ছোট্ট শাওনি অনেক কিউট তাই না? একদম তার মায়ের মত!" সাকি এক হাত দিয়ে আমার কোল থেকে ডাইরি আর কাগজগুলো নিল। অন্য হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, "আমাদের এই শাওনি টা তার চেয়েও কিউট। এসো, বাইরে সবাই দুশ্চিন্তা করছে। খুঁজছে তোমাকে!" পোট্রেট টা বুকে জড়িয়ে, সাকির হাত ধরে বেরিয়ে এলাম।ভীষণ দুর্বল,অনুভূতিহীন লাগছিল নিজেকে।আমাকে সিঁড়ি তে বসিয়ে, ডায়রি আর কাগজগুলো আমার কোলে রেখে দিয়ে সাকি অন্যদের ডাকল। তার ডাক শুনে এক এক করে সবাই এসে জমা হল আমার সামনে।ওরা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে মুখে একরাশ প্রশ্ন আর দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে। "একটা গল্প শুনবে তোমরা?" অস্পষ্ট স্বরে জানতে চাইলাম। সাকি আমার সামনে হাত ধরে বসলো,হাত দুটো মৃদু ছুঁয়ে বললো, "শুনব। . . অবশ্যই শুনব.. বল তুম!" "অনেক আগে.. ধর আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে এখানে একজন জমিদার ছিলেন। আশফাক খান। বিনয়ী,খেয়ালি এবং কৌশলী একজন মানুষ। বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র হিসেবে জমিদারি পেয়েছিলেন তিনি......

প্রজা দরদি এই জমিদার সবকিছুতেই নৈপুণ্যের পরিচয় দিতেন। পড়াশোনা করেছিলেন খুব সম্ভব হার্ভার্ড ভার্সিটিতে। বিজ্ঞানধর্মী ছিল তার চিন্তা ভাবনা, যার বহিঃপ্রকাশ তিনি বহু কাজে ঘটিয়েছেন! এবং সে কাজগুলোর মধ্যে সবচাইতে আশ্চর্য জনক কাজ ছিল এই বাড়ীর মুল দরজা! এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল দরজাটা, যাতে পরিবারের লোকজন মানে উনি আর শুধু ভবিষ্যতে উনার উত্তরাধিকারী ছাড়া, অন্য কেউ এটা ব্যবহার করতে না পারে! দরজার ম্যাকানিজমে এমন কিছু একটা যোগ করলেন, যাতে কেও দরজা খোলার আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তার পরিচয় নিশ্চিত করা যায়। অনেকটা পাসওয়ার্ডের মত! আর হ্যাঁ,এই ব্যবস্থা করার কিছুদিনের মাঝেই চাচাত ভাইয়ের হাতে মারা যান তিনি! উনার রক্তে দরজাটি আজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, পুরো পরিবার মারার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। জমিদারি,কিংবা এই বাড়ী এবং এর কোথাও লুকনো গুপ্তধন এর দখল নেয়া সম্ভব হয়না ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে। আশফাক খানের একটি মেয়ে ছিল। বাবা তার মেয়ে কে অসম্ভব ভালবাসতেন। আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন,"সোনালী মেঘ"! মেয়েটা যেদিন তার বাবা কে ডাকতে শিখল,সেদিন এ তার বাবা মারা গেলেন। কি দুর্ভাগা মেয়ে.. আশফাক খানের মৃত্যুর পর দরজার একমাত্র পাসওয়ার্ড ছিল, সেই ছোট্ট মেয়েটি।খুনিরা তাই পাগলের মতো মেয়েটা কে খোঁজে। কিন্তু আশফাক খানের বুদ্ধিমতী স্ত্রী মেয়ে কে কৌশলে ভাই এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আর নিজে বন্দী হলেন,আত্মহত্যা করলেন এরপর.. লাঞ্ছিত মৃত্যুর চেয়ে এটাই ভালো ছিল তার চোখে। নিজে বাঁচলেন না। তবে মেয়ে কে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন........" সবাইকে একনজর দেখে নিয়ে খুলের পোর্টেইট টার দিকে তাকালাম। "ছোট্ট "সোনালী মেঘ" হয়ে গেল শাওনী!

এত্তো আদরের শিশুটি একা অসহায়ের মতো বড় হলো আবাসিক স্কুল আর কলেজে। তবে তার মায়ের খুব শখ ছিল,মেয়ের মুখে অন্তত এবার একবার মা ডাক শুনবেন। মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন,নিজ হাতে খাইয়ে দেবেন,তারপর চুলে বিলি কেটে ঘুম পারাবেন। কাল রেতে তার সব আশা পূর্ণ হয়েছে। এমনকি, আক্রমণুদ্দোত শত্রু যাদের কারণে স্বামী সংসার সব হারিয়েছিলেন। . তাদের উচিত শাস্তি ও দিয়েছেন! সাকি দেখেছে তা। তারপর বিদায় বেলায় মেয়ের মাথার কাছে বসে আকুল হয়ে কেঁদেছেন ও! কিন্তু... মা একবারও ভাবলনা, আমারও কিছু চাওয়ার থাকতে পারে, জমে থাকা অভিমান থাকতে পারে . তিনি নিজেতো বিদায় বেলায় কেঁদে কিছুটা হালকা হয়েছেন! কিন্তু আমি কি করব? কিভাবে হালকা হব? কার কাছে গিয়ে বলব? কারো কোলে মাথা রেখে শব্দ করে কাঁদবো?"

মায়ের ডাইরি দুহাতে চেপে বুকে জড়িয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। "তবে আমি আমার মায়ের চেহারা একটিবারের জন্য ও দেখতে পারলাম না! একবার অন্তত জড়িয়ে ধরে বলতে পারলাম না," আমিও তোমাকে ভালবাসি,মা। হোক না তোমার অস্তিত্ব ছায়া শরীরের! তবু ও মা,আমি তোমার সেই ছায়াশরীরি অস্তিত্ব টাকেই ভালবাসি।"" "জানি তুই জোছনা রাতে, চুপটি বসে থাকবিনা। জানি তুই একলা বসে কাদবিনা। জানি তুই অন্ধকারের অন্ধঘরের একটি কোণে, নিঃস্ব হয়ে জেগে থাকবিনা, জানি তোর কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে ঝরবে শুধু, স্বপ্ন হয়ে গান গাইবেনা, চিরেধরা ভালবাসা একলা পড়ে রইবে জানি, মেঘেদের দল চোটে চলবেনা......" সাকিভীষণ দরদ দিয়ে গাইছে। আর আমি কাঁদছি।

আকুল হয়ে কাঁদছি,শব্দ করা কাঁদছি। "মা" "বাবা" কিংবা ছোট্ট "সোনালী মেঘ" এর কথা ভেবে কাঁদছি। যে কিনা একবার ও তার বাবাকে দেখার সুযোগ পেলনা জীবনে,আমি তার জন্য কাঁদছি। বন্ধুরা সব আমাকে ঘিরে বসে আছে। শাওলীন, সানতানা, অয়ন, শুভ, সাকি, নিলয়তারাও কাঁদছে। তবে নিঃশব্দে। আমি জানি আর একজন ও কাঁদছে! আর সে হলো আমার "ছায়াশরীরি মা".... উৎসর্গ: অবশ্যই আমার মায়াবতী আম্মুনিকে.. যে কিনা অন্ধভাবে ভালবাসতেই জানে শুধু!




লিখেছেন - সুজানা আবেদিন সোনালী
Courtesy: valobashargolpo.com