Monday 13 October 2014

আট কলা বিদ্যা Aat kola bidya

রহিম শেখ বড়ই রাগী মানুষ । কোন কাজে একটু এদিক-ওদিক হইলেই সে তার বউকে ধরিয়া বেধম মারে । রোজ তাদের বাড়িতে মারামারি লাগিয়াই আছে । সেদিনের একটি ঘটনা বলিতেছি ।
বউ সকালে উঠিয়া ঘর-দোর ঝাঁট দিতেছে, রহিম ঘুম হইতে উঠিয়া বলিল ‍‌“ আমার হুঁক্কায় পানি ভরিয়াছ ?” বউ বলিল, “ তুমি তো ঘুমাইতেছিলে. তাই হুঁক্কায় পানি ভরি নাই । এই এখনই ভরিয়া দিতেছি” । রহিম চোখ গরম করিয়া বলিল, “এতো বেলা হইয়াছে, তবু হুক্কায় পানি ভর নাই ! দাঁড়াও দেখাইতেছি তোমায় মজাটা” । এই বলিয়া সে যখন বউকে মারিতে উঠিয়াছে, বউ বলিল, “যখন তখন তুমি আমাকে মার-ধর কর, আমি কিছুই বলি না । জান আমরা মেয়ে জাত ? আটকলা হেকমত আমাদের মনে মনে  । ফের যদি মার তবে  আটকলা হেকমত দেখাইয়া দিব” ।
এই কথা শুনিয়া রহিম শেখের রাগ আরো বাড়িয়া গেল । সেএকটা লাঠি লইয়া বউকে মারিতে মারিতে বলিল, “ওরে শয়তানী, দেখি তোর আটকলা কেমন ? তুই কি ভবিয়াছিস্  আমি তোর আটকলাকে ডরাই ?”

বহুক্ষণ বউকে মারিয়া রহিম মাঠের কাজ করিতে বাহির হইয়া গেল । অনেক্ষণ কাঁদিয়া কাঁদিয়া বউ মনে মনে একটি মতলব আটিল । বউ-সোয়ামীর ঝগড়া সহজেই মিটিয়া যায় । দুপুরে রহিম বাড়ি আসিলে বউ রহিমের কাছে জানিয়া লইল, কাল সে কোন ক্ষেতে হাল বাহিবে । বিকাল হইলে বউ বাড়ির কাছের এক জেলেকে ডাকিয়া আনিয়া বলির ? “জেলে ভাই ! কাল ভোর হওয়ার কিছু আহে তুমি আমাকে একটি তাজা শোলমাছ আনিয়া দিবে । আমি তোমাকে এক টাকা আগাম দিলাম ।আরও যদি লাগে  তাও দিব । শেষ রাতে আমি জাগিয়া খিরকির দরজার সামনে দাড়াইয়া থাকিব । তখন তুমি গোপনে শোল মাছ আমাকে দিয়া যাইবে” ।

পাড়াগাঁয়ে একটি শোল মাছের দাম বড় জোর আট আনা । এক টাকা পাইয়া জেলে মনের খুশীতে বাড়ি ফিরিল।  সে এ-পুকুরে জাল ফেলে ও পুকুরে জাল ফেলে । কত টেংরা, পুঁটি, পাবদা মাছ আটকায় ; কিন্তু শোলমাছ আর আটকায় না । রাত যখন শেষ হইয়া আসিয়াছে তখন সত্যি সত্যি একটি শোলমাছ তার জালে ধরা পড়িল  । তাড়াতারি মনে খুশীতে সে মাছটি লইয়া রহিম শেখের বাড়ির খিড়কি-দরজায় আসিল । বউ ত আগেই সেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে । মাছটি লইয়া বউ তারতাড়ি যে খেতে রহিম আজ লাঙল বাহিবে সেখানে পুতিয়া রাখিয়া আসিল ।

সকাল হইলে রহিম খেতে আসিয়া লাঙল জুড়িল । সে এদিক হইতে লাঙল ফড়িয়া দিয়া ও দিকে যায়, ও দিক হইতে এদিকে আসে । হঠাৎ তাহার লঙলের তলা হইতেএকটি শোল মাছ লাফইয়া উঠিল । রহিম আশ্চর্য হইয়া মাছটি ধরিয়া লইয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল । তারপর বউকে বলির, “ লাঙলের তলায় এই তাহা শোলমাছটি পাইলাম । খোদার কি কুদরত ! এই মাছের কিছুট ভাজা করিবে, আর কিছুটা তরকারি করিবে । অনেকদিন মাছ ভাত খাই না । আজ পেট ভরিয়া মাছ ভাত খাইব” ।  এ্ বিলিয়া রহিম ক্ষেতের কাজে চালিয়া গেল ।দুপুর হইতে না হইতেই বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া সে বউ এর কাছে খাইতে চাহিল ।  বউ এক থাল ভাত আর কয়েকটা মরিচ পোড়া আনিয়া তাহার সামনে ধরিল ।

একে তো ক্ষুধায় তাহার শরীরে আগুন উঠিয়াছে, তাহার উপর এই মরিচ পোড়া আর ভাত দেখিয়া রহিমের মাথায় খুন চাপিয়া গেল । সে চোখ গরম করিয়া বলির, “সেই শোল মাছ কি করিয়াছিস্ শীগ্‌গীর বল ?” বউ যেন আকাশ হইতে পড়িল, এমনি ভাব দেখাইয়া বলিল, “কই, মাছ কোথায় ? তুমি কি আজ বাজার হইতে মাছ কিনিয়াছ ?

রহিম বলির, “ কেন, আমি যে আজ ইটা ক্ষেত হইতে শোলমাছটা ধরিয়া আনিলাম” । বউ উত্তর করিলম “বল কি ?ইটা ক্ষেতে কেহ কখনো শোল মাছ ধরিতে পারে ? কখন তুমি আমাকে শোল মাছ আনিয়া দিলে ? তোমার কি মাথা খারাপ হইয়াছে ?”

তখন রহিমের মাথা দাউ দাউ করিতেছে । সে চিৎকার করিয়া উঠিল,ৈ “ওরে শয়তানী ! এমন মাছটা তুই নিজে রাধিয়া খাইয়া আমার জন্য রাখিয়াছিস্‌ মরিচ-পোড়া আর ভাল ! দেখাই তোর মজাটা” । এই বলিয়া রহিম বউকে বেদম প্রহার করিতে লাগিল ।বউ চিৎকার করিয়া সমস্ত পাড়ার লোক  জড় করিয়া ফেলির, “ ওরে তোমরা দেখরে, আমার সোয়ামী পাগল ইয়াছে, আমাকে মারিয়া ফেলিল” ।

বউ এর চিৎকার শুনিয়া এ পাড়া ও পাড়া  হইতে বহুলোক আসিয়া জড় হইল । তাহার জিজ্ঞাসা করিল, “ তোমরা এতো চেঁচামেচি করিতেছ কেন ?” তোমাদের কি হইছে ? রহিম বলির, “ দেখ ভাই সকলরা, আজ আমি একটা তাজ শোলমাছ বলিয়া আনিয়া বউকে দিলাম পাক করিতে । এই রাক্ষসী সেটা নিজেই খাইয়া ফেলিয়াছে । আর আমার থালায় রাখিয়াছে এই মরিচ-পোড়া আর ভাত । আপনারাই বিচার করেন এখন বউ এর কি শাস্তি হইতে পারে ?”

বউ তখন হাত জোর করিয়া বলিল, “ দোহাই আপনাদের সকলের । আপনারা ভাল মত পরীক্ষা করিয়া দেখেন আমার সোয়ামীর মাথা খারপ হইয়া সে যা’তা’ বলিতেছে কিন ? ওর  কাছে আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, ও কোথা হইতে মাছ আনিল, আর কখন আনিল ?”

রহিম বলিল, “ আজ সকালে ঐ ইটাক্ষেতে যখন লাঙল দিতেছিলাম তখন একটি এত বড় শোলমাছ আমার লাঙলের তলে লাফাইয়া উঠিয়াছিল । সেইটি ধরিয়া আনিয়া বউকে পাক করিতে দিয়াছিলাম” ।

বউ পাড়ার সবাইকে বলির. “ আপনারা সবাই বলুন, শুকনা মাঠে তাজা শোলমাছ কেমন করিয়া আসিবে ? আমার সোয়ামী পাগল না হইলে এমন কথা বলিতে পারে”।

গায়ের লোকেরা সকলেই বলাবলি করিল, “রহিম শেখের ইটাক্ষেতের ধারে পারে কোন ইদারা-পুকুর নাই । সেখানে শোলমাছ আসিকে কোথা হইতে ? রহিম পাগল হইয়াছে”। তথন তাহারা পরামিশ করিয়া রহিমকে দড়ি দিয়া বধিতে গেল । সে যখন বাধা দিতেছিল, সকলে তখন তাহাকে কিল-থাপর মারিতেছিল । একজন বলিল, “ পানিতে চুবাইলে পাগলের পাগলামীসারে ।চল ভাই, একে পুকুরে লইয়া গিয়া কিছুটা চুবাইয়া আনি”। যেই কথা সেই কাজ  । সকলে ধরিয়া রহিমকে পুকুরে লইয়া গিয়া চুবাইতে লাগিল ।রহিম বাধা দিল । কার বাধা কে মানে ।সে যতই বাধা দেয়, তাহার তাকে ততই চুবায় । চুবাইতে চুবাইতে আধসরা করিয়া রহিমকে তাহার ঘরে লইয়া আসিল । রহিম রাগে শোষাইতে লাগিল । তখন একজন বলির, “  উহাকে আজই পাগলা গারদে লইয়া যায় । নতুবা রাগের মাথায় কাকে খুন করিয়া ফেলে বলা যায় না” ।

রহিমের বউ বলির, “আপনারা আজকের মতো ওকে ঘরের খামের সাথে বাধিয়া রাখিয়া যান । কাল যদি না সারে পাগলা গারদে লইয়া যাইবেন”।

গায়ের লোক তাহাই করিল ।রহিমকে ঘরের একটি খামের সাথে কষিয়া বাধিয়া যে যার বাড়ি চলে গেল ।

সবলোক চালিয়া গেলে বউ রহিমের হাতের পায়ের বাধন খুলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে মাছ ভাতের থালা আনিয়া তাহার সামনে ধরিল । গরম গরম পাক করা মাছের তরকারির গন্ধ সারাদিন না খাওয়া রহিমের নাকে আসিয়া লাগিল ।সে মাথা নিচু করিয়া ভাত খাইতে শুরু করিল । পাখার বাতাস করিতে করিতে বউ বলিল, “ দেখ, আমরা মেয়ে জাত আটকলা বিদ্য জানি; তারই এক কলা আজ তোমাকে দেখাইলাম । তাতেই এক কান্ড আর বাকিসাত কলা দেখাইলে কি যে হইত বুঝিতে পার” ।

রহিম বলিল, “ দোহাই তোমার আর সাতকলার ভয় দেখাইয় না । এই আমি কছম কাটিলাম । এখন হইতে আর যদি তোমার গায়ে হাত তুলি তখন যাহা হয় করিয়”।