Monday 8 September 2014

গল্পটা একটা রাক্ষসের

অভিজিত স্যার জেনেটিক্স ক্লাস নিচ্ছেন। আমরা চুপ করে তার কথা শুনছি। হঠাৎ আমার চোখ ঘুরে গেল সীমার দিকে। সীমা ইশারায় কিছু একটা বলল। ওর ইশারার অর্থ আমি যা বের করলাম, ‘ক্লাস শেষ হউক, বাইরে আয়, তোর খবর আছে।’ এমন ইশারার কারন বুঝতে আমার বেশিক্ষন লাগল না। গতকাল তন্বীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি, তাই হয়তো সীমা ক্ষেপেছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। তন্বীর প্রত্যেকটা কথা ভেঙানো, বিশ্রিভাবে ওর হাসি নকল করা, এককথায় ওকে বিরক্ত করতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। এটা মনে করার কোন কারন নেই তন্বী আমাকে পছন্দ করে। সত্যি বলতে কি, আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই যেটা দেখে কেউ আমাকে পছন্দ করতে পারে। উস্কো খুস্কো চুল, মুখ ভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পড়াশুনার ব্যাপারে ভীষণ উদাসীন, তাছাড়া সমস্ত চেহারায় আমার গুন্ডা গুন্ডা ভাব।
এত কিছুর পরও জানিনা কোন অদ্ভুত কারনে সীমা আমাকে ভীষণ পছন্দ করে। ক্যাম্পাসে সীমাই আমার একমাত্র বন্ধু। সীমা সারাক্ষন চেষ্টা করে আমাকে বদলে দিতে, পড়াশুনার ব্যাপারে সিরিয়াস করতে। সীমার আর একজন ভাল বন্ধুর নাম তন্বী। আর স্বভাবতই তন্বীর একমাত্র কাজ হচ্ছে বখে যাওয়া আমার হাত থেকে সীমাকে বাঁচানো । আর এ কারনেই আমি তন্বীকে সারাক্ষন বিরক্ত করি।
ক্লাস শেষে সীমা ওর হলের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটছে। আমিও ওর পিছু পিছু হাঁটছি। খুবই ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘‘জেনেটিক্স অনেক কঠিন বিষয় হলেও , অভিজিত স্যার কিন্তু ক্লাসে দারুন বুঝান , কি বলিস ? ”
ও বলল, “তুই আগামী দুই দিন আমার সাথে কোন কথা বলবি না।”
-“আচ্ছা।”
-“আচ্ছা মানে !! তুই কি ভেবেছিস আমি তোর সাথে ফাজলামো করছি। তুই আমার কোন কথাই শুনিস না । যা বলি ঠিক তার উল্টাটা করিস।”
-“তন্বী যে আমাকে গুন্ডা বলে গালি দিয়েছে তাকে তো কিছু বলিসনা।”
-“তোকে তো জুতা পেটা করা উচিৎ ছিল। ওর পেছনে তোর সারাক্ষন লাগতে হবে কেন। তুই আমার সাথে আগামী এক সপ্তাহ কথা বলবি না ।”
আমি মজা করে বলতে যাচ্ছিলাম, “অতিরিক্ত পাঁচ দিন কিসের জন্য ?” আমি কথা শেষ করতে পারলাম না, দেখি সীমার চোখে পানি।
কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম, “পাগলি শোন, তন্বী খুবই ভাল মেয়ে এটা আমি জানি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যেদিন শেষ হবে, তন্বী যেদিন ব্যস্ত হয়ে হয়ে পড়বে নিজের সংসার নিয়ে । সেদিন হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্মৃতি, সব বন্ধু বান্ধব, এমনকি তোকেও সে ভুলে যাবে। কিন্ত আমি তোকে গ্যারান্টি দিচ্ছি- লিখে রাখ, আমাকে সে কোনদিনই ভুলতে পারবে না।”
সীমা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। আমি বলতেই থাকলাম ....
“একদিন তন্বীর সুখের সংসার হবে। আমার কেন জানি মনে হয় ওর ফুঁটফুঁটে দুটি মেয়ে হবে। সারাক্ষন ও মেয়ে দুটোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। মেয়ে দুটো হবে দুষ্টোর শিরোমনি। তন্বী হয়তো মেয়েদের খাওয়াচ্ছে , মেয়েরা বায়না ধরবে, ‘মামণি, রাক্ষসের গল্প বল, তা না হলে খাব না।’
তন্বী মেয়েদের গল্প শোনাবে, ‘এটা একটা সত্যিকার রাক্ষসের গল্প, আমার নিজের দেখা রাক্ষস। রাক্ষসটার মাথায় ইয়া বড় বড় উস্কো খুস্কো চুল, মুখ ভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ইয়া বড় বড় দাঁত, মাঝখানের একটা দাঁত আবার ভাঙা, কুঁজো হয়ে বিশ্রিভাবে হাঁটে। অন্য রাক্ষসদের সাথে এর পার্থক্য হল এটা মানুষকে ধরে ধরে খায়না, বরং মানুষের কথা ভেঙায় । একদিন এক রাজকন্যা তার বান্ধবীদের নিয়ে গল্প করছিল। এমন সময় শয়তান রাক্ষসটা আড়াল থেকে রাজকন্যার প্রত্যেকটা কথা ভেঙাতে লাগল ”।
আমি সীমার দিকে তাকিয়ে দেখি ও মনযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে।
আমি বললাম, “আচ্ছা রূপকথার রাজকন্যারা তো অনেক সুন্দর হয়। তন্বীকে রাজকন্য বলা কি ঠিক হচ্ছে ?? ”
সীমা ভীষণ রেগে হলে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তুই আমার সাথে আগামী একমাস কথা বলবি না ” ।

রাগলে সীমাকে ভীষণ ভীষণ পঁচা লাগে। একটা কথা সীমাকে বলা হয়নি। তন্বী যখন কথা বলে , যখন হাসে ওকে তেমন ভাল লাগেনা। কিন্তু ও যখন রাগ করে তখন ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। ওকে সারাক্ষন রাগিয়ে আমি ওর সেই অসম্ভব সুন্দর মুখ দেখে মুগ্ধ হই।