Tuesday 15 March 2016

অজানা গন্তব্যে

লিখেছেন - শুকনোপাতা

ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু এখনো দেখা নেই,আশ্চর্য মানুষ!
সব সময় দেরি করেছে  বলে কি আজো দেরি করবে?!কোন মানে হয়...?!
নিতুর ইচ্ছে করছে চলে যেতে,কিন্তু পারছে না। হয়তো চলে আসবে এখনই,হয়তো জ্যামে পড়েছে...কি হয় একদিন একটু ওয়েট করলে? একটা দিনই তো...কথাটা মনে হতেই আপন মনে হেসে ফেলে নিতু। 'একটাদিন'... কখনো ভাবেনি এই 'একটাদিন' জীবনে আসবে,মন থেকে কোনদিন চায়ওনি কিন্তু কি আর করা! সব সময় সব কিছুতো আর চাওয়া অনুযায়ী হয়না।

ভাবনাটা আর বেশিদূর  এগুলো না নিতুর,নাকে খুব পরিচিত ঘ্রান অনুভব করল...কতো দিনের চেনা এই অনুভূতি!ঘাড় ফেরালো পেছন দিকে,ওকে আচানকভাবে তাকাতে দেখে একটূ চমকালো নিয়াজ!
--যেভাবে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!হাহাহা
নিতু কিছু না বলে  স্বভাবত হাসলো। মনে মনে  খুব গভীর ভাবে খেয়াল করলো নিয়াজকে। বেশ ফুরফুরে লাগছে,কিছুটা সময় নিয়ে তৈরী হয়েছে বলা যায়,আজ আর শার্টের কলার টা বাঁকানো নেই, টি-শার্ট এর কালার ও ঠিক আছে...কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিতুর বুক চিরে।
--চল,কোথাও বসি।
--কোথায় বসবে?ঢাবাতে?
নিতু আরেকবার হাসল,আজ না বলতেই ঢাবার কথা বলছে নিয়াজ!
--নাহ,লেকের পাড়েই বসবো। চল...

বলে হাঁটা শুরু করে  নিতু। ও জানে নিয়াজ কিছুটা অবাক হয়েছে,নিতু আজ নিজে থেকেই লেকের পাড়ে বসতে চেয়েছে!! নিতু বরাবরই লেকের পাড়ে বসতে বললে ভ্রু কুঁচকাতো,'কি সব জায়গাতে যে বসতে চাও তুমি!দুনিয়ার মানুষ হেঁটে যাচ্ছে,আর এমন একটা প্লেসে আমাকে নিয়ে তোমার বসতে ইচ্ছে করে...!উফফ!'কিন্তু শেষ পর্যন্ত বসতে হতো,কারন নিয়াজ নিজের যুক্তিতে অটল ছিল সব সময়।

 কোন কথা না বলে  দু'জনেই চুপচাপ হাঁটতে লাগল। নিতুর মনে হলো,একবার জিজ্ঞেস করবে,'এত চুপ করে আছো কেন?'কিন্তু করলো না,নিয়াজ যখন চুপ করে হাঁটতে পারছে তখন কি দরকার কথা বলার...! এখন আর নিতুর চুপ করে থাকাতেও তার আর কিছু যায় আসে না!আর তাইতো চুপ করে থাকছে...

ব্রিজের কাছাকাছি এসে,হঠাৎ নিয়াজ বলল,

--তোমার বাসার সবাই কেমন আছে?

--ভালো

--তোমার যে বিয়ের প্রোপজালটা এসেছিল সেটার কি খবর?

নিতু একবার নিয়াজের  মুখের দিকে তাকালো,কেমন ভাবলেশহীন কন্ঠ!

--জানিনা,কি খবর,আম্মু কিছু বলেনি আর।

--কি যেন করে ছেলেটা!জব?

--হুম,একটা মোবাইল ফোন কোম্পানিতে।

--বাড়ি আছে ঢাকাতে?

--হুম,আছে উত্তরাতে।

--ওহ,তাহলে তো ভালোই!

আবারো নিতু ওর মুখের  দিকে তাকালো,কি করে পারছে এভাবে কথা বলতে নিয়াজ!!অথচ ক'মাস আগেও তো ওর কোন বিয়ের প্রোপজাল এসেছে শুনলে ঘুম হারাম হয়ে যেতো!টেনশনে বেচারা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিতো আর আজ??!.কেন এতো বদলে গেলো নিয়াজ?...গতো সাতদিন ধরে নিতু ট্রাই করেছে নিয়াজের সাথে কথা বলার কিন্তু প্রতিবারই ক'মিনিট কথা বলেই এক কথা'নিতু এখন আর কথা বলতে পারবো না,দেখা হলে বলবো'

আর তাই তো নিতু অধীর আগ্রহ নিয়ে আজ এসেছে নিয়াজের  কথা শুনতে!

কিন্তু সেই কখন  থেকে লেকের পাড়ে চুপ করে  বসে আছে দু'জন!কেউ কোন কথা বলছে না...অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গে নিতু,

--তোমার কিছু বলার ছিল বোধহয়

ওর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক  কন্ঠে প্রশ্ন করে নিয়াজ,

 --খুব তাড়া আছে নাকি?

--নাহ,তবে তোমার কথা শোনার জন্য আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছিনা

হাসল নিয়াজ। নিতুর  মনে হলো,অনেক কষ্ট জড়ানো সে হাসি,বুকটা কেঁপে উঠলো নিতুর!

--নিতু,তোমার হাতটা কি ধরতে পারি?

--আমার হাত কি তুমি ছেড়ে দিয়েছো?

নিয়াজ কোন উত্তর  না দিয়ে নিতুর হাতটা মুঠোয়  নেয়। নিতুর অনেক কষ্টে  নিজেকে সামলে রাখে। ইচ্ছে  করছে দু'হাতে শক্ত করে নিয়াজের হাতটা ধরে রাখতে,ওর কাঁধে মাথা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতে!

--নিতু,আমার মনে হয়,তোমার আব্বুর পছন্দে বিয়ে করাটাই তোমার জন্য বেটার!

নিতুর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে...মনে  মনে এমন কথারই আশংকা  করছিলো সে!

--দেখো নিতু,তুমি তো জানোই আমার বড় দুই বোন এখনো বিয়ে করেনি,তাদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি আমাকে নিয়ে ভাবতে পারবো না। আমারো মাস্টার্স বাকী আছে,জবে ভালো একটা পজিশনে যাওয়া বাকী,এই পজিশনে আমি বিয়ে করতে পারবো না,মোট কথা আগামী দু'তিন বছরের আগে আমি তোমার ফ্যামিলিতে প্রোপজ পাঠাতে পারবো না,আর তোমার ফ্যামিলিও এতোদিন ওয়েট করবে না। সো,বেটার তুমি বিয়ে করে ফেলো..আমার জন্য অপেক্ষা করো না"

নিতুর অসম্ভব একা  মনে হয় নিজেকে..বিশাল লেকের  পাড়ে নিজেকে অনেক অনেক একা  লাগে! বেশ কিছুক্ষন পর অনিচ্ছা  স্বত্তেও হাতটা ছাড়িয়ে নেয়  নিয়াজের হাত থেকে.. আর কি হবে মানুষটার হাতে হাত  রেখে?বলেই তো দিল সে,সব শেষ! আর কি হবে?হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার সময় একবারো ধরে রাখার চেষ্টা করলো না!একবারো বলতে পারলো না,'নীতু,এ হাত শুধু আমার হাতেই থাকবে,এ হাত ধরার অধিকার শুধু আমার!'

দেড় বছরের বন্ধুত্ব আর দু'বছরের ভালোবাসা সব কিছু এখন থেকে শেষ!

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় নিতু,টলমলে পায়ে হাঁটা শুরু করে,পেছন থেকে ডাকতে থাকে নিয়াজ...

--নিতু,দাড়াও প্লিজ,কথা শোন আমার আমাকে ভুল বুঝ না,আমার সত্যি এই মুহুর্তে কিছু করার নেই...

নিতু দাঁড়ায় না,চলতে থাকে...চারপাশের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,কিন্তু নিতুর কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই...

ব্রিজ পাড় হওয়ার  সময় নিয়াজ এসে হাত ধরে,

--নিতু,স্বাভাবিক হও,প্লিজ। আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো,বাট প্লিজ,তুমি আমাকে বলো,আমি কি করতে পারি?আপুদের বিয়ে হয়নি,আমি কি করে বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারি?

চিৎকার করে উঠে  নিতু,

--কোথায় ছিল তোমার এই চিন্তা গুলো এতোদিন?দু'বছর আগে এই চিন্তা গুলো তোমার মাথায় আসেনি কেন?

তাৎক্ষনিক কোন উত্তর  দিতে পারে না নিয়াজ। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনা। কি লাভ মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে...!

নিয়াজের নিরবতা দেখে নিতু বুঝে ফেলে আর কোন লাভ  হবে না কিছু বলে...নিয়াজ  শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস  ভেঙ্গে কাপুরুষদের কাতারে যেয়ে দাড়ালো।

কিছু করার নেই তার...!এই কথা শোনার পর আর কি বাকী থাকে?! আবারো হাঁটা শুরু করে,সাথে সাথে নিয়াজও হাঁটতে থাকে,

--তোমার এখন আর আমার সাথে হাঁটার প্রয়োজন নেই,চলে যাও

--তোমাকে রিকশা করে দেই একটা?


নিতু আবারো চিৎকার করতে যেয়ে নিজেকে সামলে নেয়,

--আমাকে কি ভাবো তুমি?দয়া দেখাচ্ছ?পারবো আমি একা চলতে,তোমাকে আর ভাবতে হবে না...

বলে আর কোন কথা সুযোগ  না দিয়ে হাঁটা শুরু করে  নিতু। পেছনে দাঁড়িয়ে  থাকে নিয়াজ। নিতুর ইচ্ছে  হয় একবার পেছন ফিরে তাকাতে,একবার নিয়াজের চোখে চোখ রাখতে,মায়া ভরা কন্ঠে বলতে,''অনেক ভালোবাসি তোমাকে''। কিন্তু আর পেছন ফেরা হয় না।

নিতু-নিয়াজ চলে যায়  অজানা গন্তব্যে,পেছনে পড়ে  থাকে অসম্পূর্ন প্রতিশ্রুতি আর বিশ্বাসের ভালোবাসা...